ঢাকা সোমবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৫

র‌্যাগিং : সংস্কৃতির নামে নিষ্ঠুরতার মহড়া

সেঁজুতি মুমু
প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২৫, ০৯:০৯ এএম

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন সব শিক্ষার্থীর কাছে অনন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য, শিক্ষার্থীরা দিন-রাত এক করে লেখাপড়া করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একটা স্বপ্ন। সবার কপালে তা জোটে না। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সীমিতসংখ্যক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন প্রত্যেকের কাছে একটি অনন্য আশার জন্ম দেয়। কত রঙিন স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। কিন্তু এই দিনটির আড়ালে তাদের জন্য লুকিয়ে থাকে এক ভয়াবহ ভয় ‘র‌্যাগিং’।

পরিচয় পর্বের নামে সিনিয়র শিক্ষার্থীদের কাছে শারীরিক-মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়। র‌্যাগিং একটি ঘৃণ্য অপরাধ। এর শিকার হয়ে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, অনেকে সহ্য করতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায়। রঙিন স্বপ্নগুলো ভেঙে যায় এক দিনে। 

র‌্যাগিংয়ের প্রচলিত নাম ‘পরিচয় পর্ব’। পরিচয় পর্বের নামে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা সদ্য ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের দল বেঁধে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ডেকে নিয়ে যায়। তারপর তাদের বলা হয় সব সিনিয়রদের দেখা হওয়া মাত্রই সালাম দিতে, বিনোদনের নামে নতুন শিক্ষার্থীদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের নাচ, গান, অভিনয় করতে বাধ্য করানো হয়। পরে দেখা হলে কেউ যদি সালাম না দেয়, তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়। নতুন শিক্ষার্থীদের সিনিয়ররা ম্যানার শেখায়। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে দীর্ঘ ১৭-১৮ বছর লেখাপড়া করিয়ে, পরিবারের লোকজন কি তাদের ম্যানার শিখাতে অক্ষম হয়েছেন, যে দুদিনে ক্যাম্পাসে এসে মাত্র কয়েক বছরের সিনিয়রদের কাছে ম্যানার শিখতে হবে? অথচ এই তথাকথিত সিনিয়রদের নিজেদেরই ম্যানারসের অভাব।

তাই তারা সদ্য আসা জুনিয়রদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। হোস্টেলের রুমে রাতে ডেকে নিয়ে গিয়ে সারারাত নির্যাতন করে। এটাকে তারা বলে পরিচয় পর্ব। এভাবে নাকি সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক ভালো হয়! দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট কৌতুক এটা। সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কের কালো অধ্যায় এই তথাকথিত পরিচয় পর্ব। এই সদ্য আসা শিক্ষার্থীরা যখন সিনিয়র হয়, তখন এই পরিচয় পর্বের পরম্পরা বজায় রেখে তারাও তাদের জুনিয়রদের ওপর অত্যাচার করে। কিছু বললে তারা বলে, ‘এসব না করলে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক কীভাবে গড়ে উঠবে? আর এগুলো নিছক বিনোদন।’ সম্পর্ক বুঝি এভাবে গড়ে ওঠে? আপনারা যদি পরিচিত হতেই চান তবে তাদের ডাকুন, তাদের সাথে কথা বলুন, তাদের স্বপ্ন, বর্তমান সমস্যা জানুন।

গান বাজনা করতে ইচ্ছে করে জোর করে কেন নিজেরাও গান, ওদের যারা গান জানে তাদের নিয়ে নম্র-ভদ্র আড্ডায় মেতে উঠুন। এভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিচয় পর্ব একে বলা হয়। আর নিছক বিনোদন মানে? নতুন আসা জুনিয়ররা কি আপনাদের বিনোদনের পাত্র? নাকি ওরা আপনাদের দয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুযোগ পেয়েছে? এসব তথাকথিত পরিচয় পর্বের শিকার হয়ে নতুন শিক্ষার্থীরা মানসিক আতঙ্কে ভোগে। তারা বাসা থেকে এত দূরে অজানা পরিবেশে আসে, সব নতুন তাদের জন্য। এখানে তাদের প্রয়োজন সিনিয়রদের সাহায্য, সহমর্মিতা। কিন্তু তারা থাকে আতঙ্কে এই তথাকথিত পরিচয় পর্বের জন্য। অনেকে আত্মহত্যার পথ অবধি বেছে নেয়। বাংলাদেশে র‌্যাগিংয়ের কিছু দৃষ্টান্ত দেখা যাক:

১. ২০২৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী দুই সিনিয়রের বিরুদ্ধে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ জানান। ভুক্তভোগী মোহাম্মদ রকি জানান, দুই সিনিয়র শিক্ষার্থী তার মাকে ফোন করার জন্য চাপ দেন এবং শেষবারের মতো কথা বলে নিতে বলেন। বলতে বলেন আর কোনোদিন দেখা নাও হতে পারে। 

২. এ বছর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) এক ছাত্রীকে রাতভর মারধর ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী ছাত্রীর অভিযোগ, তাকে চড়-থাপ্পড় মেরে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছে এবং বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেছে অভিযুক্তরা।

এ রকম শত শত দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে আশার বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। র‌্যাগিংয়ের শাস্তি হিসেবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বহিষ্কার ও ছাত্রত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যা কার্যকরও হচ্ছে। কিছু দৃষ্টান্ত দেখা যাক :
১. এ বছর বাকৃবিতে র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় ৫ ছাত্রীকে শাস্তি দিয়েছে প্রশাসন। 

২. পবিপ্রবিতে র‌্যাগিংয়ের দায়ে ২০ শিক্ষার্থীর বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছে প্রশাসন। 

৩. বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের শাস্তি স্থায়ী বহিষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। 

উদ্যোগগুলো সত্যি প্রশংসনীয়। কিন্তু তবুও র‌্যাগিং থেমে নেই। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবেই এই অভিশাপ থেকে আমরা মুক্তি পাব। বর্তমানে স্নাতক প্রথম বর্ষে নতুন শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই অনেক র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। এসব প্রতিহত করতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যেমন: 

১. কঠোর আইন ও নীতিমালা প্রণয়নÑ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিংবিরোধী আইন কার্যকর করতে হবে।

২. অ্যান্টি-র‌্যাগিং কমিটি গঠনÑ শিক্ষক, প্রশাসন, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ও অভিভাবকদের নিয়ে কমিটি থাকতে হবে।

৩. সচেতনতা বৃদ্ধিÑ সেমিনার, আলোচনা সভা ও প্রচারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে।

৪. অভিযোগ গ্রহণ ব্যবস্থাÑ হটলাইন বা অভিযোগ বক্স স্থাপন করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

৫. কঠোর শাস্তি নিশ্চিতকরণÑ র‌্যাগিং করলে বহিষ্কারসহ আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

৬. সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক উন্নয়নÑ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা ও ইতিবাচক কার্যক্রমে তাদের যুক্ত করতে হবে।

৭. শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মেলবন্ধনÑ শিক্ষকরা ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করলে র‌্যাগিং প্রবণতা কমে যাবে।

৮. গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারÑ র‌্যাগিংবিরোধী প্রচার চালাতে হবে।

৯. নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ জাগ্রতকরণÑ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিকতা, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি করতে হবে।

উপরোক্ত পদ্ধতি গ্রহণ করলে আমরা র‌্যাগিংয়ের মতো ভয়াবহ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাব বলে আশা করি। র‌্যাগিংয়ের ফলে মানসিকভাবে অনেক শিক্ষার্থী ভেঙে পড়েন। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে যেন সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এভাবে এই অপসংস্কৃতি থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারব। সুস্থ স্বাভাবিক শিক্ষা পরিবেশ সবার অধিকার। তা নিশ্চিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষকেই গ্রহণ করতে হবে। 

সেঁজুতি মুমু, শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়