ঢাকা রবিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৫

দলীয় প্রার্থিতা নিয়ে সিলেট বিএনপিতে চাপা উত্তেজনা

সালমান ফরিদ, সিলেট
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২৫, ০১:২০ এএম

সিলেটে আবারও আলোচনায় বিএনপি। ঢাকায় দলীয় মহাসচিবের দিদারে ডাক পাওয়ার পর থেকে মূলত নতুন করে আলোচনা শুরু। সিলেট জেলার ছয় আসনে কারা পাচ্ছেন বিএনপির টিকিটÑ এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়েই দলীয় ও দলের বাইরের মহলে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক গুঞ্জন ও ধূম্রজাল। সবচেয়ে বেশি আলোচিত সংসদীয় আসন সিলেট-১ ও ২। দীর্ঘদিন ধরে এ দুটি আসন বিএনপির বলয়ে মাত্র দুজনের রাজত্ব স্বীকৃত ছিল। খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ছিলেন সিলেট-১-এর একমাত্র বিএনপির মনোনয়ন দাবিদার। আর সিলেট-২-এ ছিল গুমের শিকার এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদির লুনার একক রাজত্ব, কিন্তু হঠাৎ আসন দুটিতে বিএনপির প্রভাবশালী দুজন মনোনয়নের দাবি নিয়ে মাঠে আত্মপ্রকাশ করলে জন্ম হয় আলোচনার। জমে ওঠে রাজনীতির মাঠের খেলা। সিলেট-১-এ (সিলেট সদর উপজেলা ও সিটি করপোরেশন এলাকা) খন্দকার মুক্তাদিরের রানিংমেট হিসেবে দলের ‘ইজাজত’ নিয়ে আভির্ভূত হন সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। বিএনপিতে দুজনের অবস্থান সমান্তরালÑ দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। আর সিলেট-২-এ (বিশ্বনাথ ও বালাগঞ্জ উপজেলা) এসে নাম লেখান দলের মূল নীতিনির্ধারক তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। লুনার একক রাজত্বে তিনি যখন ছিলেন অনেকটা আয়েশি মেজাজে, হুমায়ূন কবির এসে অল্প দিনে তার কাক্সিক্ষত সেই আসনে দলের নেতাকর্মীদের চাঙা করে তোলেন। নড়েচড়ে বসেন লুনা।

আসন হাতছাড়া হওয়ার ভয় তাকে মুচড়ে দেয়। হুমায়ূনকে মোকাবিলা করতে তিনি নেমে পড়েন ময়দানে। ডোর টু ডোর তৎপরতা শুরু করেন। রাজত্বে আয়েশে থাকা দুজনেই নতুন মুখের আগমনে নির্বাক বনে যান। তাজ্জব হয়ে পড়েন উভয়েরই ভক্ত ও অনুসারীকুল। সেই অবস্থা এখনো কাটেনি। যদিও তাদের প্রত্যেকের অনুসারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারেক রহমানের ‘সবুজ সংকেত’ লাভের কথা প্রচার করছেন। প্রত্যেকেই দাবি করছেন, তাদের নেতা ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়ে গেছেন। যদিও দল এখনো কাউকে নির্দিষ্ট করে কিছুই বলেনি।

গত বুধবার হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে সিলেট-১-এ আরিফুল হক চৌধুরী ঘটা করে দলীয় মনোনয়নে নিজের লড়াইয়ে কথা জানান। বিশাল শোভাযাত্রা করেন সিলেট শহরে। তাতে বিপুল উপস্থিতি ও জনসমর্থন দেখে মসনদ নড়ে ওঠে খন্দকার মুক্তাদিরের। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াও জানানো হয় তার বলয় থেকে। এমনকি তিনি নিজেও একটি ভিডিওতে এ নিয়ে মন্তব্য করেন। মাজার প্রাঙ্গণে আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, আমি সিলেট-১ থেকে বিএনপির মনোয়ন চাইছি। সেই লক্ষ্যে আমার আনুষ্ঠানিক নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু হলো।

তবে আরিফুল হক চৌধুরীর শোডাউনের পর খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির বলয় ও তার তরফ থেকে যে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়, তা বেশ আত্মবিশ্বাসের। আরিফের মনোনয়ন প্রত্যাশাকে তারা খুব একটা আমলে নিচ্ছেন না বা ‘তা পালে হাওয়া পাবে না’Ñ এমন একটা অবস্থানে থেকে নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করেন। সিলেট বিএনপিতে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের আপনজন হিসেবে পরিচিত সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর ও সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, ‘সিলেট-১ আসনে খন্দকার মুক্তাদিরই বিএনপির টিকিটে নির্বাচন করবেন। তিনিই ধানের শীষের প্রার্থী, এটি নিশ্চিত। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি।’

বর্তমানে খন্দকার মুক্তাদির যুক্তরাষ্ট্রে পারিবারিক সফরে রয়েছেন। এ কারণে তিনি দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ডাকে ঢাকায়ও যাননি। সিলেট জেলার সব মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থী দলীয় মহাসচিবকে সাক্ষৎ দিতে ঢাকায় গেলেও তিনি ছিলেন অনুপস্থিত। সেই বৈঠক থেকে ফিরে আরিফুল হক চৌধুরী শোডাউনের পরিকল্পনা করেন। দুই দিনের নোটিশে ব্যাপক সাড়া ফেলার মতো জনসমাবেশ ঘটান সিলেট শহরে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এক দিন পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার দলীয় মনোনয়নে রানিংমেট খন্দকার মুক্তাদির একটি ভিডিওতে বলেন, ‘আর কাউকেই ঢাকায় মহাসচিবের বৈঠকে ডাকা হয়নি। সিলেট-১-এ একমাত্র আমাকেই দলীয় প্রার্থী হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। একমাত্র আমিই ডাক পেয়েছি।’ তবে সেই বৈঠক শেষে প্রকাশিত স্থিরচিত্রে সিলেট জেলার অন্যান্য মনোনয়নপ্রত্যাশীর সঙ্গে আরিফুল হক চৌধুরীকেও মির্জা ফখরুলের সামনে বসে কথা বলতে দেখা গেছে। কার আমন্ত্রণে বা কোন সূত্রে আরিফুল হক চৌধুরী দলীয় মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠক করে এলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি মুক্তাদির। ফলে বিষয়টি নিয়ে সিলেটে রাজনৈতিক ধূ¤্রজাল তৈরি হয়েছে। এ আসনের প্রার্থিতা নিয়েও নতুন করে হিসাব-নিকাশ কষছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।

এদিকে গত বুধবার দলীয় যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে সিলেট-২ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী তারেক রহমানের উপদেষ্টা হুমায়ুন কবিরকে বিএনপির মর্যাদাপূর্ণ যুগ্ম মহাসচিব পদে পদায়নের কথা জানানো হয়। সিলেট-২ আসনে লুনা শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হলেও হুমায়ুনের এই উত্থান তাকে বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছে। হুমায়ুন কবির গতকাল শুক্রবার সকালের ফ্লাইটে সিলেট এসে পৌঁছে সরাসরি চলে যান হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারতে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. এনামুল হক চৌধুরী, বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমরান আহমদ চৌধুরী, মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন চৌধুরী, বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ শীর্ষ অনেক নেতা। এর আগে বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে অন্যান্যের মধ্যে মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম ও ফয়সল আহমদ চৌধুরীকে দেখা যায়। তারা সবাই সিলেটের বিভিন্ন আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী।

অবশ্য হুমায়ুন কবির এতদিন সিলেট-২ আসনে প্রার্থী হওয়ার জোর চেষ্টা চালালেও শুক্রবার ঠিক সেই জায়গা থেকে তাকে পিছিয়ে আসতে দেখা গেছে। মাজার প্রাঙ্গণে ‘সিলেট-২ আসনে নির্বাচন করবেন কি-না’Ñ এমন প্রশ্নে কৌশলী জবাব দেন তিনি। ইঙ্গিতে অনেকটা প্রকাশ করে দিয়েছেন, সিলেট-২-এ তিনি হয়তো শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করছেন না। থাকছেন দলের নীতিনির্ধারণীতে। বলেন, ‘আমি নির্বাচন করা-না করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, দল নির্বাচন করবে এটিই এখন মুখ্য। সিলেটের ১৮টি আসনে একাধিক যোগ্য প্রার্থী আছেন। দল যাদের যোগ্য মনে করবে, তাদের মনোনয়ন দেবে। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবেই দলকে জয়ী করে আনব।’