ঢাকা সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৫

টাঙ্গুয়ার হাওরে জীববৈচিত্র্যের আশ্রয় ও সম্ভাবনার দিগন্ত

সানোয়ার হোসেন, মধ্যনগর (সুনামগঞ্জ)
প্রকাশিত: নভেম্বর ১০, ২০২৫, ০১:৪৫ এএম

সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর ও তাহিরপুর উপজেলার ১০টি মৌজায় বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর, প্রায় ৯ হাজার ৭শ একর আয়তনের এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির এই জলাভূমি ২০০০ সালে জাতিসংঘের রামসার কনভেনশনের অধীনে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

স্থানীয়ভাবে ‘মাছের ভান্ডার’ নামে পরিচিত এ হাওড় এক সময় ছিল দেশীয় মাছের প্রজননক্ষেত্র। জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য বলছে, প্রতিবছর এখান থেকে প্রায় ৩০০ টন মাছ আহরিত হয়। কিন্তু অবৈধ জাল ব্যবহার, প্রজনন মৌসুমে নির্বিচারে মাছ শিকার আর জলজ উদ্ভিদ ধ্বংসের কারণে মাছের প্রজাতিগুলো দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর এক জরিপে দেখা গেছে, হাওরের প্রায় ৬০ শতাংশ দেশীয় মাছ এখন বিলুপ্তির ঝুঁকিতে।

শীতকালে টাঙ্গুয়ার হাওর হয়ে ওঠে অতিথি পাখির রাজ্য। বাংলাদেশ বন বিভাগের তথ্যমতে, প্রতিবছর প্রায় দুই শতাধিক প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এখানে আশ্রয় নেয়। রাজহাঁস, গাংচিল, লালমাথা খঞ্চিলসহ নানা প্রজাতির পাখির কলতানে মুখরিত হয় পুরো হাওর।

তবে এই অপরূপ হাওর আজ নানা সংকটে জর্জরিত। সম্প্রতি হাইকোর্ট ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্তব্য করেছে, ‘সুরক্ষিত ব্যবস্থাপনার অভাবে টাঙ্গুয়ার হাওর এখন অভিভাবকহীন।’ আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, হাউসবোটগুলোর নিবন্ধন, চলাচলের রুট, কর প্রদান ও মালিকদের তথ্যসমূহ সঠিকভাবে যাচাই করতে।

পরিবেশবিদদের মতে, আদালতের এ নির্দেশ বাস্তবায়ন হলে প্রথমদিকে ব্যবসায়ীরা কিছুটা চাপে পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে এটি হাওরের পরিবেশ রক্ষা ও টেকসই পর্যটনের জন্য সহায়ক হবে।

হাওড় ঘিরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের অধিকাংশই মাছ ধরা, কৃষিকাজ ও নৌযানের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু লিজ প্রথা ও প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে সাধারণ জেলেরা প্রায়ই বঞ্চিত হন। স্থানীয় জেলে আব্দুল হামিদ আক্ষেপ করে বলেন, ‘আগে বর্ষায় নৌকা ভরে মাছ পেতাম, এখন খরচই উঠানো দায়।’

অন্যদিকে পর্যটন খাতেও টাঙ্গুয়ার হাওরের সম্ভাবনা সীমাহীন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জানায়, প্রতিবছর প্রায় তিন থেকে পাঁচ লাখ পর্যটক এখানে আসেন। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মতে, পরিকল্পিত অবকাঠামো, স্যানিটেশন, নিরাপত্তা ও নৌযান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকলে এ হাওর থেকে বছরে শতকোটি টাকা রাজস্ব আয় সম্ভব।

মধ্যনগর উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিজবাহ মনে করেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরকে রক্ষা করতে হলে এটিকে ইকো-ট্যুরিজম জোন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি অবৈধ মাছ ধরা ও বনজ সম্পদ আহরণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’

প্রকৃতির অপার লীলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু সুনামগঞ্জ নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের এক অমূল্য সম্পদ। সঠিক নীতি ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা থাকলে এটি হতে পারে পরিবেশ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং টেকসই পর্যটনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।