চাঁদের আলোর রাতে জমিদার বাড়ির সামনে এসে রিকশা থামালেন রইস উদ্দিন। ভাড়া নিয়ে তার এখানেই আসার কথা ছিল। রনি নামের যুবকটি রিকশা থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করতে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। রইস উদ্দিনের মনে হলো ত্রিশ মিনিটের এই দীর্ঘ পথের ভাড়া মাত্র ৪০ টাকা চেয়ে তিনি বড় ভুল করেছেন। পথটা বেশ ভাঙাচুরা। রিকশা টানতে বেশ কষ্ট হয়েছে। ভাড়া আরেকটু বেশি চাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু রইস উদ্দিন বেশ অবাক হলেন, যখন দেখলেন ছেলেটি ৪০ টাকার ভাড়ার জায়গায় তার হাতে ১০০ টাকার তিনটি নোট ধরিয়ে দিল। এই ৩০০ টাকা দেওয়ার কারণ কী, জানতে চাইলে রনি জানায়, ‘কিছু মনে করবেন না চাচা।
আপনার পরনের লুঙিটা বেশ পুরণো আর অনেক অংশ ছেঁড়া। আজই বাজারে গিয়ে নতুন একটি লুঙি কেনে নেবেন।’ এই ঘটনায় রইস উদ্দিনের চোখে পানি চলে এলো। নিজের দুই ছেলে হাবিব আর খোরশেদ বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা হয়েছে অনেক আগেই। ছেলেরা বাবার কোনো খোঁজখবর রাখাটা দরকার মনে করছে না। স্ত্রী মারা গেছে আটমাস হলো। মেয়ে লাভলীই এখন রইস উদ্দিনের দেখাশোনা করে। লাভলীর স্বামী জাবেদ শহরের হোটেলে রুটি বানায়। ছয় মাসের কন্যাসন্তান আছে তাদের। নাতনিকে ঘিরে রইস উদ্দিনের আনন্দের শেষ নেই।
২. ক্লথ স্টোর থেকে ২৮০ টাকার লুঙ্গি কিনে বাড়ি ফিরলেন রইস উদ্দিন। উঠোনের চকচকা চাঁদের আলোয় দাঁড়াতেই নাতিনের কান্নার গলা কানে এলো। তখন রইস উদ্দিনের মনে হলো বড় একটি ভুল করে ফেলেছেন। নাতিনের জন্যে বাজার থেকে পাউডার দুধ কিনে আনার কথা ছিল। দুধ শেষ হয়েছে সকালে। লাভলী বাবার কাছে এসে মেয়ের জন্যে দুধ কেনার আবদার করেছে। এখনো মেয়েটা নিশ্চয়ই বাবার পথ চেয়ে বসে আছে। রইস উদ্দিনের দুধ কেনার কথা মনেই ছিল না। তিনি আর ঘরমুখী হননি। রিকশা উঠোনের একপাশে রেখে আবার চলে যান বাজারে। নাতিনের জন্যে দুধ কিনতে হবে। বাজারে এসে রইস উদ্দিন বুঝতে পারলেন পকেটে যে টাকা আছে, এ টাকায় দুধ কেনা সম্ভব নয়। আরও টাকা দরকার।
কিন্তু টাকা পাবেন কই! হঠাৎ মনে হল লুঙ্গিটা দোকানদারকে ফেরত দিয়ে টাকাটা নিয়ে নিলেই সব টেনশন শেষ।
৩. রইস উদ্দিনের বক্তব্য শোনে দোকানদার চোখ কপালে তুলে বলল, ‘বিক্রির মাল আমরা তো ফেরত নেই না।’ তবু অনুনয় কণ্ঠে রইস উদ্দিনের আবদার শুনে দোকানদারের মেজাজ চরমে চলে যায়। আর কথা বাড়ান না রইস উদ্দিন। লুঙ্গিটা নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন।
আতিকের মুদি দোকানে ঢুকেন রইস উদ্দিন। আতিক তার দীর্ঘদিনের চেনা। নাতনির জন্যে দুধের পয়সার একাংশ বাকি খাতায় লিখে রাখার অনুরোধ শুনে আতিক সোজা বলে দেয়, ‘এক পয়সাও বাকি রাখা যাবে না। ব্যবসার অবস্থা ভালো না।’ তবু রইস উদ্দিন হাত জোর করে অসহায় গলায় নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে, ‘দোহাই ভাই, দুই দিনের মধ্যে টাকাটা দিয়ে দেব।’ আতিকের মন তো গলেইনি, বরং রইস উদ্দিনের এই পরিস্থিতিকে বেশি রকম বাড়াবাড়ি মনে করে বাম গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল। উঠোনে এসে দাঁড়ান রইস উদ্দিন। ঘর থেকে নাতনির কান্নার গলা এখন আর শোনা যাচ্ছে না। এতক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে হয়তো ঘুমিয়ে গেছে।
আজ চাঁদের আলো এত পড়ছে কেন কে জানে! চাঁদের এমন ঝলমলে আলো অনেক বছর দেখা হয় না রইস উদ্দিনের। এই নিশুতি রাত, এত আলো, এত আলোর মিছিলে রইস উদ্দিনের খুব কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। ক্ষুধার তোড়ে এখন যদি নাতনি ঘুমভেঙে কান্নাকাটি শুরু করে, লাভলী যদি বাবার কাছে জানতে চায় দুধ না আনার কারণ, মেয়েকে তিনি কী জবাব দেবেন! আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন