- দিনের প্রতিবাদকারীদের মধ্যেই রয়েছে রাতের লুটেরা
- অন্যতম নাটের গুরু কোম্পানীগঞ্জের ওসি
- মিলেমিশে লুটপাটে অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা
- সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ স্থানীয় সাংবাদিকদের দিকেও
সাদা পাথর এলাকা থেকে পাথর লুটের ঘটনার পেছনে নাটের গুরু হিসেবে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসির পাশাপাশি বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন নাম। বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি লুটের ঘটনায় স্থানীয় ভূমি অফিসের তহশিলদার ও পাথর ব্যবসায়ীদেরও জড়িত থাকার খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও।
গত কয়েক দিনে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের অব্যাহত অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। রাঘববোয়ালদের পাশাপাশি সেখানে পাথর লুটের নেপথ্য নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উযায়ের আল মাহমুদ আদনান।
সবচেয়ে মজার বিষয়, যারা পাথর লুটের প্রতিবাদে দিনের বেলা সোচ্চার থাকেন, আন্দোলন ও সভা-সমাবেশ করেন, তাদেরই কেউ কেউ রাতের আঁধারে নেমে পড়েন পাথর লুটে। এরই মধ্যে গোয়েন্দাদের তালিকায় জায়গা পেয়েছে তাদের নামও। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির দুটি ক্যাম্পের নামেও হচ্ছে দুর্নাম। তাদের চোখের সামনেই সংরক্ষিত পর্যটন ও বাঙ্কার এলাকা থেকে পাথর লুট হলেও নীরব দর্শকের ভূমিকা তাদের দুর্নামের কারণ।
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, পাথরখেকোদের কারণে পর্যটন স্পটের আগে রেলওয়ের রোপওয়েটি লুটেপুটে নিশ্চিহ্ন করা হয়। জায়গাটি সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে সরকার কর্তৃক ঘোষিত। অথচ লুটের কারণে পাথর ও বালুর ঢিবি সমতল এবং কোথাও কোথাও বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে। গত কয়েক মাসে সাদা পাথরের ৯০ শতাংশ পাথর ও বালু লুটপাট হয়েছে। এগুলো এরই মধ্যে ভোলাগঞ্জ থেকে সিলেটের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
গত বুধবার নারায়ণগঞ্জে ৪০ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করে র্যাব, যা সাদা পাথর থেকে লুট করে নেওয়া। ঢাকার ডেমরায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে মিলেছে সাদা পাথর এলাকার পাথর। ভোলাগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জের ছাতক, সিলেটের বিমানবন্দরের পাশের ক্রাশার মিল এলাকার ধোপাগোলসহ আশাপাশের গ্রামগুলোতে এসব পাথর ঢিবি করে রাখা হয়েছে। লোকচক্ষুর আড়াল করতে ধোপাগোল ও আশপাশে পাথর রেখে তার ওপর মাটি ও বালু দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, সাদা পাথর লুটের প্রধান নায়ক কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ শামীম, বিএনপির উপজেলা সভাপতি (পদ স্থগিত) শাহাব উদ্দিন, উপজেলার তেলিখাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু মিয়া, সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মকসুদ আহমদ, কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উযায়ের আল মাহমুদ আদনান।
তাদের সঙ্গে রয়েছে বিশাল বাহিনি। এই চক্রের কারণে একসময়ের উঁচু ও দৃষ্টিনন্দন শাহ আরেফিন টিলা এখন পরিণত হয়েছে বিশাল দিঘিতে। মিশে গেছে পাশের নদীর সঙ্গে। শামীম ছাড়াও মোস্তাকিম আহমদ ফরহাদ, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এখানে তা-ব চালিয়েছেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউসুফ আলী, উপজেলা জামায়াতের আমির ফয়জুর রহমান এবং সদর ইউনিয়ন জামায়াতের আমির জাকির হোসেনও এই পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত বলে শোনা যাচ্ছে। এমনকি জেলা জামায়াতের শীর্ষ এক নেতার নামও পাথরকা-ে জড়িয়ে গেছে, যিনি পাথর ও বালু ব্যবসার সঙ্গে আগে থেকেই জড়িত।
৫ নম্বর উত্তর রনিখাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও উপজেলার সাবেক কোষাধ্যক্ষ ‘জঙ্গলের রাজা’ খ্যাত কালা মিয়া, তার ছেলে জাহাঙ্গীর, আক্তার হোসেন এবং তার সহযোগী বিনোদ সরকারের নামও পাথরকাণ্ডে উঠে এসেছে। এই কালা মিয়া আওয়ামী লীগের নেতা হলেও গত ২৬ জুন বৃহস্পতিবার স্থানীয় ধুপড়ীপাড় বাজারে নির্বাচনি পথসভায় জামায়াতে ইসলামীর জন্য প্রকাশ্যে ভোট চেয়ে আলোচনার জন্ম দেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ভোট চাওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়। তাদের বাহিনি দিয়েই উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের উৎমা নদীতে বালু ও সাদা পাথর লুট হয়েছে। যুবদলের নেতা বাহার আহমেদ রুহেল ও মানিক, ছাত্রলীগের নেতা কবির, চোরাচালান চক্রের সক্রিয় সদস্য ফখর উদ্দিন, সেচ্ছাসেবক লীগের শাহাবুদ্দিন, আওয়ামী লীগের চিহ্নিত পাথরখেকো আব্দুল আজিজ, আমির উদ্দিনও পাথর লুটে জড়িত।
বিএনপি নেতা শওকত আলী বাবুল পাথর কোয়ারি খুলে দিতে তীব্র আন্দোলন করেছিলেন। তার নামও জড়িয়ে আছে পাথর লুটে। সূত্রের দাবি, পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় পাথরখেকোরা ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর রিসোর্টে সব সময় আড্ডা দেন। এখান থেকেই পরিকল্পনা করা হয় সাদা পাথর লুট বিষয়ে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, আলফু বাহিনী আওয়ামী আমলে ধলাই পূর্বপাড় দখলে নেয়। পরিস্থিতির বদল হলেও এখনো তারাই ধলাই নদী নিয়ন্ত্রণ করছে। আলফু মিয়ার সঙ্গে আছেন তার ভাই বিল্লাল হোসেন, আওয়ামী নেতা আমিনুল ইসলাম, আবিদুর রহমানও। সেচ্ছাসেবক লীগের প্রভাবশালী পাথরখেকো শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে রয়েছে তাদের গভীর সখ্য।
পাথর সিন্ডিকেট নিজেদের অপরাধ আড়ালে রাখতে স্থানীয় প্রেসক্লাব ও সংবাদকর্মীদেরও আর্থিক সুবিধা দেয় বলে গুঞ্জন রয়েছে। মুখ বন্ধ রাখার শর্তে শাহ আরেফিন টিলা, সাদা পাথর বিজিবি, পুলিশ, রেলওয়ে বাঙ্কার, কালাইরাগসহ বিভিন্ন স্থান ও মাধ্যম থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের নামে সপ্তাহিক অর্থ তোলার অভিযোগ বেশ পুরোনো।
কোম্পানীগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি আব্দুল আলীম এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের কোনো সদস্য অবৈধ কাজে জড়িত নন। কোনো অনুদান লুটেরাদের কাছ থেকে আসেও না।’ তার দাবি, ‘পাথর লুটকা-ে রাজনৈতিক ব্যক্তি বা স্বনামধন্য যাদের নাম আসছে, তা সঠিক নয়। তারা পাথর লুট করছেন না। পাথর লুট করছে শ্রমিকেরা। নৌকা দিয়ে শ্রমিকেরা পাথর লুট করে। যাদের নাম আসছে, তারা মূলত বালু লিজ এনেছেন। তারা বালু লিজ এনে শর্তের বাইরে গিয়ে বালু তুলছেন। আমরা তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার।’
সূত্রমতে, কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উযায়ের আল মাহমুদ আদনান সাদা পাথর ছাড়াও উৎমা ছড়া থেকে বড় অঙ্কের ভাগ নেন। সেখানে যুবদল নেতা মোস্তাকিম আহমদ ফরহাদের নেতৃত্বে ৩ টাকা ঘনফুট চাঁদা আদায়ে লুটপাট চলছে। অভিযোগ আছে, ওসি মাদক ব্যবসা থেকেও টাকা নেন। যুবদল নেতা মোস্তাকিম আহমদ ফরহাদের সঙ্গে তার সখ্য বেশি। নিয়মিত তারা ফরহাদের বাড়িতে গভীর রাত অবধি আড্ডা দেন। সুসম্পর্ক বাজায় রাখেন আলোচিত যুবদল নেতা বাহার আহমেদ রুহেল ও যুবদল নেতা রজন মিয়ার সঙ্গে।
উযায়ের আল মাহমুদ আদনানের আওয়ামীপ্রেম এখনো আগের মতোই। প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা ইকবাল ও আওয়ামী নেতা ইয়াকুব আলীর বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মার্কেটের সামনে ‘পাহারা’ দেওয়ার জন্য সব সময় পুলিশের গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখতেন তিনি। এখনো তাদের প্রতিষ্ঠান ও বাড়ির সামনে প্রায়শই পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
সাদা পাথর থেকে পাথর লুটের পর কমে গেছে পর্যটক আসা। আগের মতো সেখানে ব্যবস্থাও নেই। অন্যান্য সময় শুক্রবার সাদা পাথরে পর্যটকদের ভিড় থাকত সবচেয়ে বেশি। গতকাল ছিল প্রায় ফাঁকা। নৌকার ঘাটেও কমেছে কোলাহল। সেখানে থাকা দোকানে-দোকানে নানা পণ্যের সমারোহ, তবে ক্রেতা নেই। ঘোড়াচালকেরাও বেকার সময় কাটাচ্ছেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন