কাজী সায়েমুজ্জামান। ছিলেন দেশের তুখোড় সাংবাদিক ও কবি। দৈনিক মানবজমিন দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু।
রিপোর্টার হিসেবে আলোচিত অসংখ্য খবরের জন্ম দেওয়ায় একসময় ঢাকার সংবাদপাড়ায় হয়ে ওঠেন আলোচিত মুখ। সৎ ও সাহসী সাংবাদিক হিসেবে যখন একের পর এক আলোচিত রিপোর্টের জন্ম দিচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় ঘটে ছন্দপতন। সাংবাদিক হলেও তার শখ প্রশাসনে কাজ করার। দ্বিতীয় দফার প্রচেষ্টায় উত্তীর্ণ হয়ে যান ‘বিসিএস’ পরীক্ষায়। ডাক পড়ে শখের সেই প্রশাসনে। ছেড়ে দেন সাংবাদিকতা।
এরপর থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে একজন পুরোদস্তুর সরকারি কর্মকর্তায় পরিণত করেন। চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সেই মাঠ চষে বেড়ানো আলোচিত সাংবাদিক কাজী মো. সায়েমুজ্জামান আজ এগিয়ে গিয়েছেন সাফল্যের উচ্চ শিখরে। তিনি এখন পঞ্চগড় জেলার জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
সাংবাদিক থাকাকালে কাজী সায়েমুজ্জামান যেমন আলোচিত, সৎ ও সাহসী ছিলেন, সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার পরও ছিলেন অবিকল আগের মতনই। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দায়িত্ব পালনকালেই তিনি সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
সেখানকার (পটুয়াখালী-৩ আসনের) তৎকালীন আওয়ামী লীগের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বালু মহাল বন্ধসহ বিভিন্ন বিরোচিত পদক্ষেপ তাকে প্রথম আলোচনায় নিয়ে আসে।
এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনে পরিচালকের দায়িত্ব পালনের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে হাত দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে অভিযান চালিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মকর্তাদের গোপন ভল্টের তথ্য সায়েমুজ্জামানই প্রথম জাতির সামনে নিয়ে আনেন। এ ঘটনাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
রহস্যজনকভাবে সায়েমুজ্জামানের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে উচ্চমহলের চাপে তাকে প্রথম সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান ও পরে দুদক থেকে সরিয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে বদলি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
ছাত্র জামানা থেকেই লেখালেখিতে হাতেখড়ি তার। ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। দৈনিক যুগান্তর স্বজন সমাবেশের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন ছিলেন মানবজমিন পরিবারের সদস্য। মানবজমিনেই তিনি একাধিক আলোচিত খবরের জন্ম দেন।
রাজধানী ঢাকার অলিগলি মাড়িয়ে নিয়ে আসতেন খবরের ভেতরের খবর। দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আলোচিত সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরিতেও ছিলেন বেশ পারদর্শী। পরে ইংরেজি দৈনিক নিউএজ-এ সিনিয়র প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। তিনি প্রায় দশ বছর সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িত ছিলেন।
গেল রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-২ শাখা থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে তাকে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিবের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা কাজী মো. সায়েমুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী তিনি। পরে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে কিউং হি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ট্রেড পলিসি বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তার জন্ম ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়ায়। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের বাউফলের ঐতিহ্যবাহী জমিদার- কাজী পরিবার।
বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের একজন সদস্য হিসেবে বিভিন্ন সময় সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী কমিশনার (ভূমি), সিনিয়র সহকারী কমিশনার, সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এ ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রেক্টরের একান্ত সচিবেরও দায়িত্ব পালন করেন। জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপিতে লিয়েনে চাকরিও করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের স্পর্শকাতর এটুআই প্রোগ্রামে ন্যাশনাল কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন অনেকদিন। শিল্প সচিবের একান্ত সচিবও ছিলেন।
যশোর জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করার সময়ও বেশ সুনাম অর্জন করেন। সেখানে আদালতে লেগে থাকা মামলাজট দ্রুত কমিয়ে আনতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। তার আদালতের সেই কার্যক্রম গণমাধ্যমে তখন বেশ আলোচিত হয়।
এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনে উপপরিচালক হিসেবে যোগ দেন কাজী সায়েমুজ্জামান। পরবর্তীতে উপসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর পরিচালক হিসেবে বিমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান শাখার পরিচালকের দায়িত্ব পান। তার নেতৃত্বে আর্থিক খাতের দুর্নীতি তদন্ত শুরু হলে দেশব্যাপী সেটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। একপর্যায়ে আর্থিক খাতের লুটপাটকারী রাঘববোয়ালদের দুর্নীতি অনুসন্ধান করতে শুরু করেন তিনি।
দুর্নীতি দমন কমিশন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুরের অর্থপাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তাকে সম্পদের বিবরণী জমা প্রদানের নোটিশ দেন।
তবে এস কে সুর সম্পদের হিসাব না দিয়ে উল্টো পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামানের নামে রিট করেন। পরে সম্পদের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে পরিচালকের নেতৃত্বে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে এস কে সুরের বাসা তল্লাশি করা হয়। এ অভিযানে নগদ প্রায় ১৬ লাখ টাকা, ২ কোটি ৬০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রসহ কয়েকটি ফ্ল্যাটবাড়ির তথ্য পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে আদালতের আদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে তল্লাশি শেষে এক কেজি ৫ গ্রাম সোনা, ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার, ৫৫ হাজার ইউরো ও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ৭০ লাখ টাকার এফডিআর পাওয়া যায়।
এ অভিযান তাকে দেশব্যাপী পরিচিতি এনে দেয়। একপর্যায়ে বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে ঘটনাটি ভিন্ন খাতে নেওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক তার বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখার নালিশ করে। পরে তাকে দুদক থেকে প্রত্যাহার করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।
তবে দেশের মানুষ তার বদলিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার পক্ষে লোকজন মতামত প্রকাশ করে। তৈরি হয় ব্যাপক জনমত। গত ৯ নভেম্বর তাকে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পদায়ন করা হলে সামাজিক মাধ্যমে তাকে নিয়ে নজিরবিহীন উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে।
কাজী সায়েমুজ্জামান জনগণকে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি সাহিত্যও চর্চা করছেন। তার প্রথম কবিতার বই ‘তোমাকে দেখার পর’ একুশে বইমেলায় কারুবাক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ হলে পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। মাত্র দুই বছরে দুটি সংস্করণ শেষ হয়ে যায়।
তিনি বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, আরবি, উর্দু এবং হিন্দি ভাষাও অনর্গল কথা বলতে পারেন। ছোটবেলা থেকে কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে পরিচিত ছিলেন কাজী সায়েমুজ্জামান।
তার এককালের সহকর্মী এবং রুমমেট, দৈনিক মানবজমিনের নগর সম্পাদক ও প্রধান প্রতিবেদক লুৎফর রহমান বলেন, কাজী সায়েমুজ্জামান যেখানেই দায়িত্ব পান সেখানেই নতুন কিছু করে নজির সৃষ্টি করেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশনে দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে হাত দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি।
জেলা প্রশাসক হিসেবে তিনি নতুন কোনো উদাহরণ তৈরি করবেন এটা আমার বিশ্বাস। সাবেক সহকর্মী হিসেবে কাজী সায়েমুজ্জামানকে যতটুকু জানি, তিনি আপাদমস্তক সৎ, নির্লোভ এবং দেশপ্রেমে উজ্জীবিত একজন্য কর্মকর্তা।
কাজী সায়েমুজ্জমান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সবসময় দায়িত্বকে দেশ ও দশের সেবা হিসেবে দেখেছি। সেটি সাংবাদিক হিসেবে হোক আর সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে হোক। ফলে আমার ভেতরে মানুষের কল্যাণের স্পৃহা তাড়া দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। আমি বিশ্বাস করি, দেশ পিছিয়ে নেই।
তাকে সবাই মিলে ইতিবাচক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় এগিয়ে নিতে চাইলে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। অন্য অনেকের মতনই আমি আমার জায়গা থেকে সেই চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, নতুন দায়িত্ব একটি চ্যালেঞ্জিং সময়ে পাওয়া। তবে আমি সবসময়ই চ্যালেঞ্জকে উপভোগ করি। তাকে সেভাবে গ্রহণ করে দেশ ও দেশের মানুষকে সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করি। এবারও তার ব্যত্যয় হবে না। ইনশাআল্লাহ, জেলা প্রশাসক হিসেবে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আমি সর্বোচ্চটা দিয়ে পালনের চেষ্টা করব।


সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন