সম্প্রতি দেশে নানা রকম সহিংসতা, খুন ও চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বিশেষ বা চিরুনি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির ১১তম সভায় এ তথ্য জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি জোর দিয়ে বলেন, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের ধরতে এ অভিযান চালানো হবে। এ বিষয়ে পুলিশের মন্তব্য- ‘কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’ আমরা মনে করি, এটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে এর বাস্তবায়ন যেন নিরপেক্ষ, পেশাদার ও মানবাধিকার-সম্মত হয়, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে সহিংসতা ও অপরাধ প্রবণতা যে মাত্রায় পৌঁছেছে, তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। রাজধানীর মিটফোর্ডে ভাঙারি ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে হত্যা, খুলনায় নির্মম হত্যাকা-সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা মানুষের নিরাপত্তা চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ অবস্থায় শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, বরং গোটা জাতিকেই জেগে উঠতে হবে। সরকার চিহ্নিত অপরাধীদের ধরতে যে অভিযান শুরু করেছে, তা সঠিক পথে পরিচালিত হলে সরকারের প্রতি জনআস্থা ফেরানো সম্ভব হবে। তবে এখানেই রয়েছে বড় চ্যালেঞ্জ। অতীত অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, এমন বিশেষ অভিযানে অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিরোধীদের দমন, সাধারণ নিরীহ মানুষকে হয়রানি কিংবা প্রকৃত অপরাধীকে ছাড় দিয়ে অপরাধীর বদলে নিরপরাধ কেউ শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে। এসব ঘটনা জনগণের আস্থাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই এবারের অভিযান যেন বাস্তব অর্থে সন্ত্রাস-অপরাধ দমনে কার্যকর হয় এবং কোনোভাবেই যেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার না হয়, এটি সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ অভিযান তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন তা হবে গোয়েন্দা তথ্যভিত্তিক, নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পরিচালিত। অভিযানের নামে যদি নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা হয়রানি শুরু হয়, তাহলে এর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আন্তরিকতা, দক্ষতা ও সততার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় সমাজের মূল সমস্যাগুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কেবল বাহ্যিক প্রদর্শনী করে গেলে তা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান বয়ে আনবে না। এ ছাড়া সরকারের একার পক্ষে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তাই সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে, বিশেষ করে তরুণ সমাজ, শিক্ষক, অভিভাবক, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে এ উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব অপরাধ সম্পর্কে সত্য এবং নির্ভুল তথ্য দিয়ে প্রশাসনকে সহায়তা করা। একই সঙ্গে জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে- আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও জনসচেতনতার প্রয়োজনীয়তা। কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়, সেটি যেমন জরুরি, তেমনি অপরাধ ঘটলে তা সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এই চর্চা গড়ে তুলতে পারলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমবে, অপরাধী ধরাও সহজ হবে। অতএব, চিরুনি অভিযান যেন কেবল একটি তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া না হয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ হয়। এটি সরকারকে গুরুত্বসহকারে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অভিযানে সফলতা তখনই আসবে, যখন প্রকৃত অপরাধীরা বিচারের মুখোমুখি হবে এবং নিরপরাধ মানুষ রক্ষা পাবে। তাই যেকোনো মূল্যে এই অভিযান সফল করতে হবে এবং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার এই প্রচেষ্টা যেন সত্যিকার অর্থেই আশার আলো হয়ে ওঠে সেদিকে সর্বোচ্চ মনোযোগী হতে হবে।