ভাষা মূলত যোগাযোগের মাধ্যম। কিন্তু যখন ভাষাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন সেটি বিভাজন ও সন্ত্রাসের জন্ম দেয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে আজ সেই বাস্তবতাই ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। ভারতবর্ষ তার বহুভাষিক ঐতিহ্য ও বহুসাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য বিশ্বের মানচিত্রে এক অনন্য দেশ। এখানে শত শত ভাষা ও উপভাষা মানুষের পরিচয়, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বহন করে চলেছে।
এই ভাষাগত বৈচিত্র্য ভারতীয় সংবিধান ও গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি। তবু দুঃখজনক হলেও সত্য, যে বাংলা ভাষাকে ভারত সরকার ২০২৪ সালে ‘ধ্রুপদি ভাষা’-এর মর্যাদা দিয়েছে, সেই ভাষার বহু নাগরিক আজও নানাভাবে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার। বিশেষত বাংলাভাষী মুসলিম নাগরিকদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও শোচনীয়। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। এ দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, ভাষার বৈচিত্র্য ও আঞ্চলিক পরিচয় নিয়ে গর্বিত হওয়া উচিত।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ভাষা নিয়ে এক অস্বাস্থ্যকর রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ভাষা যে মানুষের মৌলিক পরিচয়ের অন্যতম ভিত্তি তা আমরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহিদদের কাছে শিখেছি। অথচ আজ বাংলার মাটিতেই বাংলাভাষাকে নিয়ে হীনম্মন্যতা তৈরি করা হচ্ছে আবার উল্টোদিকে জোর করে ভাষার আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
এই দ্বৈত সন্ত্রাসকে আমরা ভাষা সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু বলতে পারি না। ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত ২২টি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্বজুড়ে সম্মানিত। ভারত সরকার বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদি মর্যাদা দিয়ে স্বীকার করেছে যে এর ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শাস্ত্রীয় ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরোনো এবং বিশ্বমানবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো সরকারি স্বীকৃতি কাগজে সীমাবদ্ধ থেকে গেলে কি ধ্রুপদি মর্যাদার অর্থ পূর্ণ হয়? যদি সেই ভাষার বক্তারা, বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ নিয়মিত বৈষম্যের শিকার হন তবে এ স্বীকৃতির গুরুত্ব কতটুকু? ভাষাগত কারণে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম সম্প্রদায়, মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা অধিকার ও সম্মান সবচেয়ে ভয়ানক ঝুঁকির সম্মুখীন।
পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খ-, বিহারসহ ভারতের নানা প্রান্তে বাংলাভাষী মুসলিমদের উপস্থিতি দীর্ঘদিনের। তাদের অধিকাংশই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ দেশের মাটি আঁকড়ে আছেন। তবুও জাতীয়তা ও ভাষাগত পরিচয়ের কারণে প্রায়ই তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়। বিশেষত আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) প্রক্রিয়া কিংবা ‘বিদেশি’ তকমা দেওয়ার রাজনীতি বাংলাভাষী মুসলিমদের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা স্পষ্টকণ্ঠে বলেছেন আদমশুমারিতে কেউ মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা লিখলে তিনি বাংলাদেশি বলে গণ্য হবেন। একজন মুখ্যমন্ত্রীর এ ধরনের কা-জ্ঞানহীন বক্তব্য ভাষার জন্য জাতিগত বৈষম্যকে উসকানি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। বেসরকারি ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিকল্পিতভাবে প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও মুসলিমরা আক্রান্ত হচ্ছে। জবাবদিহির কোনো ব্যাপার নেই। অপরাধীরা এখন তাই বেপরোয়া।
ভারতের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন দেশের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। গণতন্ত্র সুরক্ষার প্রহরী। বাংলাভাষী মুসলিম নাগরিকদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে সেই প্রতিষ্ঠান এখন জাতীয় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। বর্তমান তার ভূমিকা হাতের পুতুলের মতো। বিহার রাজ্যে ইতোমধ্যে সংশোধিত খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে আট কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬৫ লাখ ভোটার বাদ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন যাদের প্রত্যেকেই বাংলাভাষী মুসলিম। ক্ষমতাসীন গেরুয়া বিভেদকামী কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন ও সংঘাত সৃষ্টি করে হিন্দু ভোট মেরুকরণ করতে চাইছে যাতে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে স্কুল-কলেজে বাংলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বহু সরকারি অফিসে বাংলার ব্যবহার নামমাত্র। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি উঠলেই সেটিকে আঞ্চলিকতাবাদ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। আবার অন্যদিকে কিছু গোষ্ঠী জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। এতে যেমন বাঙালি ভাষাভাষীরা আতঙ্কিত, তেমনি অবাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যেও ভয় ও অবিশ্বাস বাড়ছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে বাংলা ধীরে ধীরে তার স্বাভাবিক গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য হারাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের সচেতন মহল এ নিয়ে প্রতিবাদে সরব হলে তাদের আঞ্চলিকতাবাদী বা বাঙালি উগ্রবাদী বলে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে।
এই মানসিকতা দীর্ঘমেয়াদে বাংলার অস্তিত্বকেই বিপন্ন করবে। গণতন্ত্র মানে বহুত্ববাদকে সম্মান করা। তাই আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের প্রচলিত হিন্দি, উর্দু, ওরাঁও, সাঁওতালিসহ অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিও সমানভাবে সম্মানিত হওয়ার দাবিদার। কারণ বাংলা এই অঞ্চলের মাটি ও মানুষের পরিচয় বহন করে। ভারতের সংবিধান নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ, নিজস্ব ভাষায় সংস্কৃতি চর্চা এবং সরকারি কাজে ভাষা ব্যবহারের অধিকার দিয়েছে। সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, প্রাথমিক স্তরে শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
একইভাবে সংবিধান সংখ্যালঘুদের ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতি রক্ষার অধিকার নিশ্চিত করেছে। তাহলে কেন বাংলাভাষী নাগরিকরা এ অধিকার থেকে বঞ্চিত? কেন তাদের মাতৃভাষাকে শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন ও দৈনন্দিন নাগরিক সেবায় যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না? ভাষার ওপর দমন-পীড়ন কেবল একটি সাংস্কৃতিক সমস্যা নয়, বরং এটি নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন।
১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাভাষা নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীও বেশি বাড়াবাড়ি করেছিল, যার পরিণতি পাকিস্তানের জন্য ভালো হয়নি। বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে কোনো অশুভ প্রচেষ্টাকে বাঙালি কখনো মেনে নেয়নি। বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষায় ১৯৫২ সালে ঢাকায় এবং ১৯৬১ সালে আসামের শিলচরে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতেও বাঙালি পিছু হটেনি। ভাষা নিয়ে বাঙালির আবেগকে অসম্মানিত করলে তার পরিণতি যে ভালো হবে না, সেটা ভারতের ক্ষমতাসীন সরকার যত তাড়াতাড়ি বুঝত ততই মঙ্গল।
মো. তাহমিদ রহমান, শিক্ষক ও কলামিস্ট
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন