দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ জেলা ভোলায় উত্তোলনযোগ্য আরও ৫ দশমিক ১০৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাসের সন্ধান বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। গ্যাজপ্রম, বাপেক্স ও পেট্রোবাংলার যৌথ গবেষণায় প্রাপ্ত এই তথ্য প্রমাণ করে যে, দেশীয় সম্পদ দিয়েই আমাদের বড় অংশের জ্বালানি চাহিদা পূরণ সম্ভব। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই সুখবরটি দীর্ঘদিন ধরে জনগণের কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছে, আর কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে এখনো যুক্ত করা যায়নি।
বাংলাদেশে প্রতিদিনের গ্যাস চাহিদা প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট, অথচ সরবরাহ হচ্ছে দুই হাজার ৬০০ মিলিয়নের মতো। এই ঘাটতি পূরণে সরকার বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির পথে হাঁটছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। অথচ ভোলায় যদি নতুন আবিষ্কৃত গ্যাস উৎসগুলো দ্রুত জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করা যায়, তাহলে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে এগোনো সম্ভব।
অভিযোগ রয়েছে, অতীত সরকার এই গ্যাস আবিষ্কারের খবর চেপে গিয়েছিল শুধু এলএনজি আমদানিকারক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য। এতে যেমন জাতীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষও উচ্চমূল্যের গ্যাস ও বিদ্যুতের বোঝা বহন করছে। জাতীয় সম্পদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে এমন গোপনীয়তা ও স্বার্থান্ধ নীতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিপন্থি।
ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আনার ক্ষেত্রে এলএনজি আকারে সরবরাহের প্রস্তাব এসেছে, কিন্তু এতে খরচ অনেক বেড়ে যায়। বাস্তবে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হলোÑ পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ। ইতোমধ্যে ভোলা-বরিশাল-ঢাকা রুটের প্রাক-সমীক্ষার কাজ শুরু হয়েছে, তবে গতি অত্যন্ত ধীর। এদিকে প্রতিদিন শিল্পাঞ্চলে গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে পড়ছে, যা অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ভোলায় ইতোমধ্যে নয়টি কূপ থেকে প্রতিদিন ১৯০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু চাহিদা না থাকায় ব্যবহৃত হচ্ছে এর অর্ধেকেরও কম। আরও ১৫টি নতুন কূপ খননের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে উৎপাদন সক্ষমতা ৩০০-৪০০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত করা সম্ভব। অর্থাৎ পরিকল্পিতভাবে এই সম্পদ কাজে লাগাতে পারলে দেশের প্রায় এক বছরের গ্যাস চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।
গ্যাস একটি জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেশের সামষ্টিক স্বার্থই হওয়া উচিত সর্বোচ্চ বিবেচনা। কিন্তু অতীত সরকার উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানির সুবিধাভোগী মহলের স্বার্থ রক্ষায় ভোলার এই সম্ভাবনাময় মজুতের তথ্য গোপন করেছে, এমন অভিযোগ গুরুতর এবং উদ্বেগজনক। যদি সত্যিই এমনটি ঘটে থাকে, তবে এটি জনগণের প্রতি প্রতারণা, অর্থনীতির প্রতি অবহেলা এবং জ্বালানি নীতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছু নয়।
সরকারের উচিত এখনই দৃঢ় অবস্থান নেওয়া। ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তির প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ও বিদেশি নির্ভরতা কমানো এই তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জ্বালানি খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ব্যবসায়িক প্রভাবমুক্ত সিদ্ধান্তই পারে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
আমরা মনে করি, ভোলা-বরিশাল-ঢাকা পাইপলাইন দ্রুত বাস্তবায়নই এখন সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত পথ। পাইপলাইনের মাধ্যমে স্থায়ী, টেকসই ও স্বল্প ব্যয়ে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব। পাশাপাশি নতুন কূপ খনন, অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার এবং গ্যাস সংরক্ষণ ও পরিকল্পনায় বিজ্ঞানসম্মত নীতিমালা গ্রহণ জরুরি। দেশের জ্বালানি নীতি কখনোই আঞ্চলিক লাভ-ক্ষতি কিংবা ব্যবসায়িক চাপের কাছে জিম্মি হতে পারে না। জাতীয় সম্পদের ব্যবস্থাপনা হবে জাতির স্বার্থে, দীর্ঘমেয়াদে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।
ভোলার গ্যাস শুধু জ্বালানি নয়, এটি আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রতীক হতে পারে, যদি আমরা সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি। জাতীয় সম্পদ রক্ষায় এখনই প্রয়োজন দৃঢ় সদিচ্ছা, কার্যকর পরিকল্পনা ও জবাবদিহিমূলক বাস্তবায়ন।
আমরা আশা করব, শুধু ভোলার গ্যাস নয় দেশের সব জাতীয় সম্পদ রক্ষার জন্য সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কেননা, একটি দেশের জাতীয় সম্পদ শুধু প্রাকৃতিক সম্পদেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতার প্রতীক।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন