সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


এম এ হোসাইন, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২৫, ০১:৫২ এএম

আমেরিকার নাগরিক জাগরণ

এম এ হোসাইন, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২৫, ০১:৫২ এএম

আমেরিকার নাগরিক জাগরণ

যখন লাখ লাখ আমেরিকান নাগরিক রাস্তায় নেমে স্লোগান তোলে ‘নো কিংস’, তা শুধু একটি প্রতিবাদ নয়, বরং একটি নাগরিক ধর্মোপদেশ। গত ১৮ ও ১৯ অক্টোবর ২০২৫-এ, ২৭০০ শহরে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ একযোগে রাস্তায় নামে। তাদের অভিযোগ, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গণতন্ত্রের সীমারেখা অতিক্রম করে এক ধরনের স্বৈরাচারী পথে এগোচ্ছেন। টাইমস স্কয়ার থেকে শুরু করে ন্যাশনাল মল পর্যন্ত, তাদের বার্তা ছিল স্পষ্ট: ‘আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়’Ñ এই প্রজাতন্ত্রের মূল আদর্শ এখনো বেঁচে আছে, যদিও তা কঠিন পরীক্ষার মুখে।

‘নো কিংস’ আন্দোলন আমেরিকার বিপ্লবী অতীত থেকে নৈতিক অনুপ্রেরণা নিলেও এর লক্ষ্য দলীয় নয়, বরং সার্বজনীন সাংবিধানিক উদ্বেগ। তাদের মূল স্লোগান- ‘কোনো সিংহাসন নয়। কোনো মুকুট নয়। কোনো রাজা নয়।’ যা ১৭৭৬ সালের ঐতিহাসিক চেতনা ফিরিয়ে আনে সতর্কবার্তা হিসেবে। তারা যে স্বৈরাচারের আশঙ্কা করছে তা বন্দুকধারী সৈন্য নয়, বরং প্রতিষ্ঠানগুলোর নীরব ক্ষয়, সীমাহীন নির্বাহী ক্ষমতার স্বাভাবিকীকরণ এবং জনতাবাদের আড়ালে নাগরিক সংযমের বিলুপ্তি।

৭০ লাখ মানুষের একত্রে রাস্তায় নামা ছিল (যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ) রাজনৈতিক উদাসীনতার বিরুদ্ধে এক প্রচ- প্রতিবাদ। ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের পর এটিই ছিল সবচেয়ে বড় জনসমাবেশ, যেখানে ভোটের বাক্সের বাইরেও স্বাধীনতার ভাষা উচ্চারিত হয়েছে। সমাবেশগুলো ছিল শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল এবং সংগঠিত। এসিএলইউ, মুভঅন, ইনডিভাইজিব্যল এবং শিক্ষক সংগঠনগুলো লজিস্টিক সহায়তা ও উত্তেজনা প্রশমনের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল।

যদিও রঙিন পোস্টার, বিশাল ‘উই দ্য পিপল’ ব্যানার ও ট্রাম্পের বেলুনে ভরা উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল, তবু এর অন্তরালে ছিল এক গম্ভীর অশনি সাংবিধানিক হৃৎস্পন্দন। অংশগ্রহণকারীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেনÑ গোপন আটক, রাজ্য সরকারের ওপর ফেডারেল হস্তক্ষেপ, শহরের সামরিকীকরণ, স্বাস্থ্যসেবায় কাটছাঁট এবং দলীয় জটের কারণে চলমান প্রশাসনিক অচলাবস্থা নিয়ে।

এই আন্দোলনের বিশেষত্ব ছিল এর পরিসর নয়, বরং এর আদর্শিক কাঠামো। বিক্ষোভকারীরা পরিচিত রাজনীতি বা বিচ্ছিন্ন নীতিগত অভিযোগকে কেন্দ্র করে জড়ো হননি; তারা জমায়েত হয়েছিলেন সাংবিধানিক ভারসাম্যের নীতিকে ঘিরে। এই পরিবর্তনটি গুরুত্বপূর্ণ। এটি ইঙ্গিত দেয় যে আমেরিকার সাংস্কৃতিক বামপন্থি শক্তি, দীর্ঘকাল যারা সামাজিক ন্যায়বিচার ও পরিবেশগত উদ্যোগে ব্যস্ত ছিল, তারা পুনরাবিষ্কার করেছে ধ্রুপদি উদারনীতির ভাষা: আইনের শাসন, ক্ষমতার বিভাজন, এবং নির্বাহী কর্তৃত্বের সীমানা।

ভার্জিনিয়ার এক প্রবীণ সৈনিকের ভাষায়, ‘আমি লড়েছি এক প্রজাতন্ত্রের জন্য, কোনো রাজবংশের জন্য নয়।’ এই বার্তা মতাদর্শের সীমা ছাড়িয়ে যায়। ‘নো কিংস’ তাই ডান-বাম উভয় শিবিরের মানুষকে আমন্ত্রণ জানায়Ñ যারা ব্যক্তিপূজার চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সততা রক্ষায় বিশ্বাসী।

আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো, সবচেয়ে নাটকীয় প্রতিক্রিয়াটি এসেছিল রাস্তা থেকে নয়, বরং ওভাল অফিস থেকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি এআই-তৈরি ভিডিওর মাধ্যমে এই আন্দোলনকে উপহাস করেন, যাতে তাকে একটি মুকুট পরা অবস্থায় বিক্ষোভকারীদের উপরে একটি যুদ্ধবিমান চালাতে দেখা যায়। যা ছিল তার দাম্ভিকতা ও বিদ্রুপের স্বভাবসিদ্ধ মিশ্রণ। তার উদ্দেশ্য ছিল- ‘আমি রাজা নই’- এই অভিযোগ নিরসন করা, কিন্তু বিক্ষোভকারীদের এই ধারণাকেই শক্তিশালী করেছিল যে, তিনি এই তুলনায় মনে মনে খুশি হয়েছেন।

প্রশাসন এবং রিপাবলিকান শিবিরের প্রতিক্রিয়া ছিল প্রত্যাশিত। টেক্সাস ও ভার্জিনিয়া ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করে; হাউস স্পিকার মাইক জনসন এসব সমাবেশকে ‘ঘৃণার রাজনীতি’ বলে অভিহিত করেন। ট্রাম্পপন্থিরা ‘আইন ও শৃঙ্খলা’র দোহাই দিয়ে প্রতিবাদকে বিশৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করে। অথচ এই জনতা ছিল শান্ত, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও বহু-প্রজন্মের। এই জনতা বিশৃঙ্খলা নয়, বরং গণতান্ত্রিক প্রাণশক্তির মূর্ত প্রতীক ছিল।

তবে সমালোচকদের প্রশ্ন যুক্তিযুক্তÑ শুধু প্রতিবাদই কি গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারে? আগের অভিজ্ঞতা যেমন: ২০১৭ সালের ‘মার্চ ফর ওমেন’ বা ২০২০ সালের ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’, হৃদয় নাড়ালেও নীতি পরিবর্তনে সীমিত প্রভাব ফেলেছিল। ‘নো কিংস’ সংগঠকেরা তা জানেন। তাদের পরিকল্পনা হলোÑ প্রতিষ্ঠানগত ক্ষয়কে দৃশ্যমান করা এবং ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ভোটারদের মাঝে এই চেতনার সক্রিয়তা জাগিয়ে রাখা।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান। ডেমোক্রেটরা ‘গণতন্ত্র রক্ষা’কে নির্বাচনি ভাষার অংশ করেছে। চাক শুমার ও পিট আগুইলার আন্দোলনের চেতনায় সমর্থন জানিয়ে ভোটাধিকারের প্রসার ও নির্বাহী জবাবদিহিতা জোরদারের আহ্বান জানান। তবে এক দ্বিধা রয়ে গেছেÑ‘নো কিংস’ যেমন ডেমোক্রেট ভোটারদের উজ্জীবিত করছে, তেমনি ট্রাম্পের বিরোধিতাকে রিপাবলিকান ঘাঁটি আরও দৃঢ় করছে।

রিপাবলিকানদের কৌশল আরও সরল কিন্তু তেমনি হিসেবিÑ প্রতিবাদকে ‘চরমপন্থি’ বলে চিহ্নিত করে তারা ‘বাস্তব আমেরিকা বনাম অভিজাত শহুরে এলিট’-এর আখ্যান জোরদার করছে। মেরূকরণই ট্রাম্পবাদের অক্সিজেন; প্রতিটি মিছিল, প্রতিটি স্লোগান তার সমর্থকদের চোখে নতুন প্রমাণ হয়ে ওঠে যে প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

‘নো কিংস’-এর সত্যিকারের পরীক্ষা এখনো বাকি। যদি এটি কেবল এক নৈতিক প্রদর্শনী হয়, তবে তা ইতিহাসে আরেকটি ব্যর্থ প্রতিবাদের অধ্যায় হবে। কিন্তু যদি এটি রাজনৈতিক সংগঠনে রূপ নেয়Ñ ভোট, নাগরিক অংশগ্রহণ ও স্থানীয় সংগঠনের মাধ্যমে, তবে এটি ২০২৬ সালের নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে।

এখনই আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে না, তবে ক্ষয়ে যাচ্ছেÑ অভ্যুত্থান বা ট্যাংকের মাধ্যমে নয়, বরং অবিশ্বাস, ক্লান্তি এবং আইনের বদলে আনুগত্যের সংস্কৃতির মাধ্যমে। এমন বাস্তবতায়, লাখো মানুষকে সংবিধানের নীতির পক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তায় নামতে দেখা আশাব্যঞ্জক। এটি প্রমাণ করেÑ জনতাবাদের কোলাহলের মাঝেও আমেরিকার নাগরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা এখনো টিকে আছে।

তবে গণতন্ত্র টিকে থাকার জন্য শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রয়োজন বুদ্ধিদীপ্ত নাগরিক অংশগ্রহণ। যে নাগরিকরা উচ্ছ্বাসকে প্রজ্ঞায় রূপান্তর করতে পারে, যারা জানেÑ প্রতিষ্ঠান রক্ষা মানে তাদের ভেতরেই কাজ করা, তারাই প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রহরী। ‘নো কিংস’ কেবল একটি স্লোগান নয়; এটি এক চিরন্তন সত্যের পুনঃস্মরণ-স্বাধীনতা শুধু স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ নয়, বরং ক্ষমতার সীমা মেনে চলার অনুশাসন।

অক্টোবরের এক সপ্তাহান্তে আমেরিকা সেই সত্যটি আবার স্মরণ করেছিল। এখন প্রশ্নÑ তারা কি এই স্মৃতি টিকিয়ে রাখতে পারবে? নির্বাচনের মাধ্যমে? আইন প্রণয়নের মাধ্যমে? নাগরিক পুনর্জাগরণের মাধ্যমে? ইতিহাসের পাতায় এই আন্দোলন কি শুধুই এক অধ্যায় হয়ে থাকবে, নাকি এক নতুন ভিত্তি রচনা করবে, ফলে সেই উত্তরই নির্ধারণ করবে আমেরিকার গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। আমেরিকার মহিমা কখনো তার নেতাদের মধ্যে ছিল না; বরং তাদের রাজা বানাতে অস্বীকৃতির মধ্যেই ছিল।

এম এ হোসাইন, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!