এই মুহূর্তে সবার মনে একটি প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত কী ঘটতে চলেছে দেশে? চরম এক অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। দারুণ হতাশা, পারস্পরিক অশ্রদ্ধা, অবিশ্বাস, বিদ্বেষ, নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে সবার সর্বসম্মতিক্রমে ও সমঝোতার ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে।
আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম, এবার বাংলাদেশ সত্যিকারের গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাবে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে যে বিশৃঙ্খলা অরাজকতা অনিয়ম চলছিল তা কাটিয়ে এবার একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে দেশে, তেমন আশায় বুক বাঁধলেও এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে সবকিছু তছনছ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। চব্বিশের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী শেখ হাসিনার দুঃশাসন হটাতে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, ছাত্র-জনতা, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিল।
অগ্নিঝরা ৩৬ দিনের আন্দোলনে শামিল দেশের মানুষের সামনে টিকতে না পেরে স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। সেটা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অসাধারণ অধ্যায়ের সূচনা। গোটা বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছিল লৌহ মানবী হিসেবে কুখ্যাত স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার ভয়ানক পতন। দেশে ভয়ংকর একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বলতে হয়, সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা? দেশের এক জায়গায় মলম লাগাবেন আরেক জায়গায় ফোঁড়া বের হবে। টোটকা-ফোটকায় কাজ হবে না।
একটা সামাজিক বিপ্লব আজকে ফরজ হয়ে গেছে। কেউ জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে না, আমরা আমজনতা ঠকি। কেন ঠকি? জমি বর্গা দেওয়া যায়, স্বার্থ বর্গা দেওয়া যায় না। যারা এতদিন দেশ চালিয়েছে, লুটপাটতন্ত্র কায়েম হয়েছে। লুটপাটের রাজত্ব বহাল রাখার জন্য মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে। এমনকি ভোটাধিকার পর্যন্ত হরণ করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে এক দুর্যোগের ঘনঘটা। একটা গভীর সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ নিপতিত হচ্ছে। একটা গভীর খাদের কিনারে এসে বাংলাদেশ এখানে উপনীত হয়েছে।
জুলাই জাতীয় সনদ ও তা বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তার অবসান ঘটিয়ে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দিকে মনোযোগী হতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। যা হওয়ার হয়েছে। ওই সমস্যাগুলো সমাধান করে যাতে সবাই একসঙ্গে আমরা নির্বাচনের দিকে যেতে পারি, এই সমস্যার সমাধান করে আমরা জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করতে পারি, সেই পথে এগিয়ে যেতে হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে হস্তান্তরের পর থেকে বিএনপি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। দলটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ার তপশিলে সংস্কার প্রস্তাবগুলোই শুধু উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’গুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া কমিশনের সভায় আলোচনা হয়নি, এমন বিষয়ও যুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট নিয়েও আপত্তি রয়েছে বিএনপি। আজকে যে সংকট তৈরি করেছে এই অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশন। আমরা বিশ্বাস করি যে এই সংকট কেটে যাবে। এই দেশের মানুষ কখনো পরাজিত হয় না। পরাজয় বরণ করেনি, পরাজয় বরণ করবে না। যেকোনো চক্রান্তকে পরাজিত করতে সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তাকে পরাজিত করতে হবে।
এখানে আমরা বিভিন্ন দল করতে পারি, বিভিন্ন মত থাকতে পারে, বিভিন্ন পথ থাকতে পারে, কিন্তু একটা বিষয়ে আমরা সব সময় এক ছিলাম, বাংলাদেশের ব্যাপারে; সবার আগে বাংলাদেশÑ এ বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক জীবনে হতাশাবাদী হলে চলবে না; কারণ, আমরা বিশ্বাস করি যে ন্যায়ের জয় হবেই, সত্যের জয় হবে। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকা সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমরা যেমন অতীতে একসঙ্গে ছিলাম, সব সময় একসঙ্গে থাকব।
এই মুহূর্তে ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। জনগণের বৃহত্তর ঐক্য ছাড়া এই ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার পতন হবে না। ফ্যাসিবাদ থাকলে বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক, কর্মচারী, নারী, জাতিগত বা ধর্মীয় নিপীড়িত মানুষের কোনো দাবি আদায় হবে না। কোনো একক দলের পক্ষে শেখ হাসিনার কায়েম করা ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার বদল সম্ভব নয়। আজকে আমরা নির্বাচনি গণতন্ত্রের কথা বলছি। কিন্তু এই নির্বাচনি গণতন্ত্র যদি খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার রক্ষার গণতন্ত্রে পরিণত হতে না পারে, তাহলে এই গণতন্ত্র টেকে না।
সে কারণে আমরা রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি, দেশের সামাজিক ব্যবস্থা, দেশের সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাÑ সবকিছু পরিবর্তনের জন্য লড়াই করেছি। মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার সে জন্য দেশের বিদ্যমান রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলাই এখন প্রধান কর্তব্য। বাংলাদেশের মানুষ আজকে এমন একটা লক্ষ্য নিয়ে সামনে যাচ্ছে, কোনো কিছুই আর তাকে পিছুটান দিতে পারবে না। সেই পিছুটান যারা দেবে, যারা কোনো না কোনোভাবে, অন্য কোনো নামে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করতে চাইবে, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করতে চাইবে, তাদের এ দেশের জনগণ আর গ্রহণ করবে না।
কাজেই এ দেশে জাতীয়তাবাদের নামে যেমন ফ্যাসিবাদ চলবে না, কোনো মতবাদ দিয়ে কোনো ফ্যাসিবাদ এ দেশে গ্রহণযোগ্য হবে না। গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য বিচার, সংস্কার, নির্বাচনÑ সবকিছুই অপরিহার্য, ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া আমাদের রাজনৈতিক উত্তরণ হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ তৈরি না করে জুলাই জাতীয় সনদ কার্যকর করতে হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক শাসনতান্ত্রিক কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। ফ্যাসিবাদী শাসন ও বৈষম্য থেকে এখনো মুক্তি মিলেনি; বরং দেশ এখন গভীর সংকটে রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন জাতির প্রধান দাবি। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়েজনের নামে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও সময়ক্ষেপণ করা উচিত হবে না। দেশ এখন জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আছে।
ফ্যাসিবাদ থেকে মানুষ মুক্তি চেয়েছিল। একটা অরাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয়েছে। আমরা সবাই তাদের নৈতিকভাবে সাপোর্ট করেছি। শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যের আলোচনা করে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে দেশের মানুষ যদি মনে করে দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, আমি মনে করি সেটা ভুল করবে না। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না। যদি এটা করতে চান, জনতার মুখোমুখি হতে হবে। কাজেই সব বাদ দিয়ে নির্বাচনটা দিতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে ন্যূনতম ঐকমত্য গঠিত হয়েছে, সেটার ওপর ভিত্তি করে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলো পরবর্তী পরিক্রমায় সেগুলো পালন করবে।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এই সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এ ছাড়া আইনজ্ঞ, সংবিধানবিশেষজ্ঞ ও সচেতন নাগরিকদের কেউ কেউ এটা নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে।
তবে গণভোট কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে গণভোট কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে হবে, নাকি আগে হবে। যে আদেশের ভিত্তিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা হবে, তার নাম হবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’। ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি করা হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। এর মধ্যে ৪৮টি সংবিধান-সম্পর্কিত। বাকি প্রস্তাবগুলো অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। এ বিষয়ে দলগুলোর মতৈক্য আছে। মূল বিতর্ক সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে। সনদ ও গণভোটের আইনি ভিত্তি, গণভোটের সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা আছে।
৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে সংবিধান-সম্পর্কিত ৪৮টি প্রস্তাব বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশন দুটি বিকল্প সুপারিশ করেছে। একটিতে বলা হয়েছে, ২৭০ দিনের মধ্যে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে। সে ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বিল আকারে আদেশের তপশিলে থাকবে। অন্য সুপারিশ অনুযায়ী, গণভোট হবে আদেশ ও আদেশের তপশিলে থাকা সংস্কার প্রস্তাবের ওপর। তবে দুটি বিকল্প উপায়ের কোনোটিতেই সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গণভোটে রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) গুরুত্ব পাবে না। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, সেভাবেই তা বাস্তবায়িত হবে।

