ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৫

সুগন্ধার পেটে বাপ-দাদার ভিটা

মশিউর রহমান, নলছিটি
প্রকাশিত: আগস্ট ১৯, ২০২৫, ০৮:২১ এএম

# টানা ৫০ বছর ধরে নদীর দুই পাড়
# অবৈধ বালু উত্তোলনে ভাঙন তীব্র হচ্ছে
# দফায় দফায় বাড়ি ছেড়েও মিলছে না রক্ষা
# বিলীন শত শত কোটি টাকার জমি ও সম্পদ

টানা ৫০ বছর ধরে সুগন্ধা নদীর ভয়াবহ ভাঙনের কবলে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি, মগড়সরই, খোজাখালী, দরিরচর, তিমিরকাঠি, সিকদারপাড়া, কাঠিপাড়া, বহরমপুরসহ ১০টিরও বেশি গ্রাম। দীর্ঘ এই ভাঙনে হাজার হাজার মানুষ হারিয়েছে বসতভিটা, ফসলি জমি, পান বরজসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদ। দফায় দফায় বাড়ি ছেড়েও রক্ষা মিলছে না বাসিন্দাদের। বর্ষা মৌসুম এলেই নদীপাড়ের মানুষেরা শঙ্কায় দিন কাটান।

জানা যায়, সুগন্ধা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২১ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৪০০ মিটার। এটি বরিশাল ও ঝালকাঠি জেলার মধ্যে প্রবাহিত প্রধান নৌপথ। অবৈধ বালু উত্তোলন, বর্ষাকালে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি ও জোয়ার-ভাটার কারণে নদীর তীর দুর্বল হয়ে ভাঙনের তীব্রতা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

স্থানীয়রা জানান, নদীভাঙনে ইতিমধ্যে শত শত কোটি টাকার জমি ও সম্পদ বিলীন হয়েছে। বর্তমানে স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ অসংখ্য মানুষের বসতঘর হুমকির মুখে রয়েছে। এখন যা অবশিষ্ট আছে, তা-ও হারানোর শঙ্কায় আছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

এমন পরিস্থিতিতে ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবিতে সম্প্রতি মানববন্ধন করেছে স্থানীয়রা। তারা বলেন, ভাঙনকবলিত এলাকায় কোনো বেড়িবাঁধ নেই। এ কারণে বর্ষায় পানি ঢুকে ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। এখনই ব্যবস্থা না নিলে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে বেশ কয়েকটি গ্রাম। দীর্ঘদিন ধরে নদীভাঙনের কথা জানানো হলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

সরই গ্রামের মাকসুদা বেগম বলেন, আমার স্বামীর বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পরে আমার ছেলেরা অন্য জায়গায় বাড়ি করেছিল, সেটিও নদীর পেটে গেছে। এমনকি স্বামীর কবরটাও নদীর মধ্যে চলে গেছে।

কাঠিপাড়া গ্রামের ইউসুফ হাওলাদার জানান, আগে এখানে ২০-৩০টি বসতবাড়ি ছিল, এখন মাত্র ২-৩টি পরিবার আছে। নদী আমাদের সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে নদীর তীর দুর্বল ও গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় বর্ষাকালে স্রোতের চাপ বেড়ে ভাঙন তীব্র হচ্ছে। যদিও নলছিটি উপজেলা প্রশাসন মাঝে মাঝে অবৈধ বালু উত্তোলনের দায়ে জেল-জরিমানা করে থাকে, তবে তা বন্ধ হচ্ছে না। বরং রাতের আঁধারে অবৈধ বালু উত্তোলনের কার্যক্রম জোরদার রয়েছে। দেখে মনে হয়, প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তা করা হয়।

সরই গ্রামের ইউপি সদস্য বেল্লাল হোসেন মোল্লা অভিযোগ করেন, আমরা অনেকবার ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি, কিন্তু কাজের কোনো অগ্রগতি নেই, শুধু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে।

বারইকরণ গ্রামের হেপী বেগম জানান, ঘর গোছাতে গোছাতে নদী এসে মেঝে স্পর্শ করছে। আমাদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোথায় যাব বুঝতে পারছি না।

মগর ইউনিয়নের জাহাঙ্গীর মাঝি, দুলাল মাঝি, নূর আলম খান ও ফরিদসহ অনেকে জানান, বাপ-দাদার বসতভিটা নদীতে বিলীন হয়েছে। তারা আশঙ্কা করছেন, যদি সরকার এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তবে পুরো গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, নদীর ভাঙন রোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণ, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের পুনর্বাসন ও আর্থিক সহায়তা, স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ করতে হবে।

ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম নিলয় পাশা বলেন, নলছিটি ও ঝালকাঠির ভাঙন এলাকা নিয়ে একটি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। অন্যান্য ভাঙন স্থানে জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে সুগন্ধা নদীর দীর্ঘস্থায়ী ভাঙনে ঝালকাঠির হাজারো পরিবার একদিন সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে যাবে।