ঢাকা শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৫

আলো বিলিয়ে অন্ধকারে শিক্ষকের নিঃসঙ্গ জীবন

বরগুনা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২৫, ০২:৩০ এএম
  • পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে চলাফেরা করতে পারছেন না
  • অবসরকালীন ভাতা এখনো পাননি, চিকিৎসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছে ছেলে
  • দীর্ঘ ১৮ বছর বিদ্যালয়ের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন, নিজের স্বার্থ কখনো ভাবেননি

বরগুনা সদর উপজেলার রায়েরতবক জেলখানা সোনাতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক আলতাফ হোসেন। জীবনের তিরিশ বছর উৎসর্গ করেছেন শিক্ষা ও বিদ্যালয় গড়ার কাজে। কিন্তু সেই শিক্ষকই আজ নিজের জীবনের শেষ প্রান্তে এসে চিকিৎসা আর অবসরকালীন প্রাপ্য টাকা না পেয়ে কাটাচ্ছেন এক নিঃসঙ্গ, কষ্টভরা জীবন।

তিন বছর আগে, ২০২২ সালের মে মাসে, শারীরিক অসুস্থতার কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই স্বেচ্ছায় অবসর নিতে হয় তাকে। বয়সের ভার আর পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে আজ তিনি চলাফেরায়ও অক্ষম। প্রতিদিন প্রায় ৩০০ টাকার ওষুধ আর নিয়মিত চিকিৎসার খরচ বহন করতে হিমশিম খাচ্ছেন একমাত্র ছেলে আল-আমীন, যিনি বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত।

১৯৯৩ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন রায়েরতবক জেলখানা সোনাতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তখন স্কুলটি ছিল কুঁড়েঘরের মতো, টিনের ছাউনি, কাঁচা মাঠ আর সীমিত শিক্ষার্থী নিয়ে। আলতাফ হোসেন ও তাঁর সহকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সেই বিদ্যালয় আজ বহুতল ভবন সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। ১৯৯৭ সালে তিনি এমপিওভুক্ত হন এবং দীর্ঘ ২৯ বছর নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।

সহকর্মী ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের স্মৃতিতে, আলতাফ হোসেন ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, যিনি ঝড়-বৃষ্টি, শীত কিংবা অসুস্থতা কোনো কিছুই তোয়াক্কা না করে নিয়মিত স্কুলে যেতেন, ক্লাস নিতেন, শিক্ষকদের তদারকি করতেন।

সাবেক শিক্ষার্থী সালমান হোসেন বলেন, ‘আলতাফ স্যার আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি অসুস্থ থাকলেও ক্লাস নেওয়া বন্ধ রাখেননি। তার মতো শিক্ষকরা জাতি গড়ার কারিগর। কিন্তু আজ এমন একজন শিক্ষক চিকিৎসাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন, এটা আমাদের জন্য লজ্জার।’

আরেক সাবেক শিক্ষার্থী হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘স্যার শুধু নিজের দায়িত্বই পালন করেননি, স্কুলের প্রতিটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর খোঁজখবর রাখতেন। এখন তিনি অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছেন। আমরা চাই সরকার যেন এমন শিক্ষকদের প্রতি দায়িত্বশীল হয়।’

অবসরের পরপরই ২০২২ সালের শেষ দিকে আলতাফ হোসেনের নামে প্রায় ৩৫ লাখ টাকার অবসরকালীন ভাতা পাওয়ার জন্য আবেদন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, আবেদনটি যায় বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্টে। কিন্তু তিন বছর কেটে গেলেও আজও সেই টাকা পাননি তিনি।

তাঁর ছেলে আল-আমীন বলেন, ‘বাবা সব সময় স্কুল নিয়েই ভেবেছেন। নিজের পরিবারের উন্নতির দিকে কখনো তাকাননি। এখন তিনি এত অসুস্থ যে বিছানায় শুয়ে থাকেন সারাক্ষণ। ওষুধ কেনার টাকাটাও জোগাতে কষ্ট হয়। যদি দ্রুত অবসর ভাতার টাকা পেতাম, বাবার চিকিৎসায় অন্তত কিছুটা স্বস্তি আসত।’

বাঁশ বুনিয়া এলাকার টিনের ঘরে স্ত্রী, ছেলে ও নাতিদের সঙ্গে থাকেন এই প্রবীণ শিক্ষক। এখন তাঁর হাতে-পায়ে অনবরত কাঁপুনি, মুখে অস্পষ্ট উচ্চারণ, হাঁটতে গেলেও অন্যের সহায়তা প্রয়োজন। নিজের জীবনের সর্বোচ্চ সময়টুকু দিয়েছেন শিক্ষার আলো ছড়াতে, অথচ আজ তিনি আলোহীন অন্ধকার ঘরে পড়ে আছেন নীরবে।

একজন শিক্ষক শুধু পাঠদান করেন না, তিনি মানুষ গড়েন। সেই মানুষ গড়ার কারিগর আলতাফ হোসেন আজ রাষ্ট্রের উদাসীনতার শিকার হয়ে জীবনের শেষ অধ্যায়ে যুদ্ধ করছেন টাকার অভাব ও অসুস্থতার সঙ্গে।