ঢাকা বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৫

ট্রলিং বোটে ধ্বংসের মুখে মৎস্যসম্পদ

তাপস মাহমুদ, বরগুনা
প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৫, ০১:৫৭ এএম

অবৈধ ট্রলিং বোটের দৌরাত্ম্যে ধ্বংস হচ্ছে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য সম্পদ। ফলে দিনকে দিন উৎপাদন ও প্রজনন কমেছে। এরই মধ্যে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সমুদ্রে দেখা দিয়েছে মাছের সংকট। অবৈধ ট্রলিংয়ের দৌরাত্ম্য চলতে থাকলে খুব দ্রুত সমুদ্রে মাছের আবাসস্থল ও বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের মুখে পড়বে।

এদিকে অবৈধ ট্রলিং বোট বন্ধের দাবি জানিয়েছেন মৎস্যজীবীরা। তারা বলছেন, যেখানে সাধারণ জেলেরা সরকারের নিষেধাজ্ঞা মেনে ইলিশ রক্ষা করছে সেখানে প্রশাসনের নীরবতায় অবৈধ ট্রলিংয়ের মাধ্যমে সমুদ্রে মাছ ধরা হচ্ছে। এভাবে অবৈধ ট্রলিং বোট চলমান থাকলে হুমকির মুখে পড়বে মৎস্যখাত। বিপাকে পড়বেন জেলেরা। এটি বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে।

সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে অবৈধ কাঠের তৈরি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলিং ট্রলার বন্ধের দাবিতে বরগুনার পাথরঘাটায় কয়েক হাজার জেলে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। 

জানা গেছে, কাঠের তৈরি ট্রলারে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন লোহার উপকরণ যুক্ত করে সমুদ্রে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে মাছ আহরণের জন্য তৈরি করা হয় ট্রলিং বোট। নিষিদ্ধ এই নৌযান সমুদ্রে মাছ আহরণে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। সাগরে যেখানে মাছ ডিম ছাড়ে, খাবার খায় ও বসবাস করে সেগুলো ধ্বংস করছে ট্রলিং বোটগুলো। এতে মাছের প্রজননে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

গভীর সমুদ্রে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলিং বোর্ডগুলো ৪০ মিটার গভীরতার বেশি পানিতে মাছ শিকার করছে, কিন্তু সক্ষমতা না থাকায় কাঠের তৈরি অবৈধ ট্রলিং বোটগুলো মাত্র ৫-১০ মিটার গভীরতায় গিয়ে মাছ আহরণ করছে। এসব অবৈধ ট্রলিং বোটের ছোট ফাঁসের জালে মারা পড়ছে সব আকৃতির মাছ। ফলে উপকূলের কাছাকাছি বড় মাছ আসতে পারে না। তাদের দৌরাত্ম্যে ধ্বংস হচ্ছে সমুদ্রে মাছের আবাসস্থল। ফলে এখন আর জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না মাছ, ফিরতে হয় শূন্য হাতে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে মৎস্য শিল্পে জড়িতরা। এভাবে অবাধে ট্রলিং বোট চলতে থাকলে আগামী ৪-৫ বছরে সমুদ্রে আর কোনো মাছ পাওয়া যাবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ট্রলারমালিক বলেন, রূপান্তরের জন্য এসব ট্রলারের ইঞ্জিনকক্ষের ওপর বড় আকারের স্টিল কাঠামো তৈরি করা হয়। এরপর হাইড্রোলিক বা গিয়ারচালিত উইঞ্চ সংযোজন করা হয়, যা দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাল তোলা ও ফেলা যায়। সঙ্গে বসানো হয় পুলি, দড়ি, চাকা ও শক্তিশালী ডিজেলচালিত জেনারেটর। মাছের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য মোবাইল ফোন অ্যাপভিত্তিক জিপিএস ব্যবহার করা হয়। ৪০ মিটার গভীরতায় না পৌঁছাতে পারায় এসব ট্রলার উপকূলীয় অগভীর এলাকায় জাল ফেলে এবং ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে রেণু, ডিম, পোনা সব ধ্বংস করছে।

সমুদ্রগামী ট্রলারের জেলে আবুল কালাম জানান, সাগরে ট্রলিং বোটের অত্যাচারে আমরা এখন নিঃস্ব হওয়ার পথে। এরা সাগরে আমাদের জালের ওপর দিয়ে তাদের জাল টানায়, ফলে আমরা অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হই। প্রতিবাদ করলে তারা আমাদের ওপর হামলা করে।

পাথরঘাটা উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব কামরুল ইসলাম বলেন, কাঠের তৈরি এসব ট্রলিং ট্রলার সংখ্যা বেড়েই চলছে। তারা সমুদ্র ও নদীতে ছোট পোনা, ডিমওয়ালা মাছসহ সামুদ্রিক সম্পদ ধ্বংস করছে। ফলে ভবিষ্যতে ইলিশসহ নানা প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির মুখে। এভাবে চলতে থাকলে সাগর নদীতে মাছ পাওয়া যাবে না।

জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সাধারণ জেলেরা সরকারের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা মেনে ইলিশ রক্ষায় সহযোগিতা করেছি। অথচ কিছু প্রভাবশালী ট্রলিং ট্রলার মালিক প্রশাসনের নীরবতায় সাগরে অবৈধভাবে মাছ ধরছে, ইলিশের পোনা ধ্বংস করছে। এটা শুধু জেলেদের ক্ষতি নয়, জাতীয় সম্পদের ওপরও বড় হুমকি। যদি দ্রুত এসব অবৈধ ট্রলিং ট্রলার বন্ধ না করা হয়, তাহলে সাধারণ জেলেরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবেন বলে জানান তিনি।’

উপজেলা প্রশাসন ও মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, অবৈধ ট্রলিং বোট বন্ধে সোচ্চার রয়েছেন তারা। বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসিন বলেন, নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে মাছ আহরণ ও অসাধু জেলেদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কোস্টগার্ড সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। তাদের সঙ্গে মিলে ট্রলিং বোট বন্ধে কাজ করা হচ্ছে।