আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার হিসেবে পরিচিত বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মাহাথির মোহাম্মদ। দেশটির রাজনীতি তো বটেই, পাশাপাশি বিশ^রাজনীতির নানান বর্ণময় অধ্যায়ের সাক্ষী তিনি। গত ১০ জুলাই ১০০ বছরে পা রাখা মাহাথির মোহাম্মাদ এখনো মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। জন্মদিনের প্রাক্কালে বার্তা সংস্থা আনাদোলুকে নিজের জীবন ও রাজনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে এক সাক্ষাৎকার দেন তিনি। সেখানে মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, ভেঙে পড়েছে আধুনিক সভ্যতা।
সাক্ষাৎকারে মাহাথির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, গণতন্ত্র মানুষের তৈরি, এটি কখনো নিখুঁত হতে পারে না। গণতন্ত্রকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে এর থেকে ভালো কিছু পাওয়া সম্ভব নয়।
মাহাথির মোহাম্মদের জন্ম মালয়েশিয়ার কেদাহ রাজ্যের প্রধান শহর আলোর সেতারে ১৯২৫ সালের ১০ জুলাই। তার দাদা ভারতের কেরালা থেকে সেখানে অভিবাসী হন। বাবা মোহাম্মদ ইস্কান্দার ছিলেন ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের প্রধান শিক্ষক। গাইনোকোলজিতে এমবিবিএস শেষ করে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন মাহাথির। শুরু করেন চিকিৎসাসেবা। এ সময় তিনি বুঝতে পারেন, বিপুল মানুষের সেবার জন্য রাজনীতির বিকল্প নেই। সেই চিন্তা থেকে রাজনীতির ময়দানে পা রাখেন। ১৯৮১ সালে ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) থেকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মাহাথির মোহাম্মদ। মোট ২৪ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাহাথির। ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত টানা ২২ বছর। এরপর ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দুই বছর।
আশির দশকে ‘লুক ইস্ট পলিসি’ বা পূর্বকে অনুসরণ করার নীতি গ্রহণ করেন মাহাথির। অর্থনীতির পশ্চিমা মডেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমান। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথিরের প্রথম ২২ বছরে মালয়েশিয়ায় পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, এক্সপ্রেসওয়ে, বিমানবন্দরসহ নানা অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। ১৯৯৭ সালের অর্থনৈতিক সংকটও দক্ষতার সঙ্গে সামাল দেন তিনি। সর্বোপরি মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন তিনি। অবকাঠামোগত নজিরবিহীন পরিবর্তন এসেছিল তার হাত ধরে। তবে মাহাথিরের বিরোধী মত দমন, মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে সীমিত অঙ্গীকার নিয়েও কম আলোচনা হয়নি।
রাজনীতি ও গণতন্ত্র বিষয়ে মাহাথির মোহাম্মদের ধারণা, বহুদলীয় গণতন্ত্রই দুর্বলতা তৈরি করে। এ বিষয়ে তার বক্তব্য, ‘গণতন্ত্রে শুধু দুটি রাজনৈতিক দল থাকলে ভালো হয়। তখন একটি জিতবে, একটি হারবে। এভাবে একটি শক্তিশালী সরকার গঠন সম্ভব। কিন্তু সবাই নেতা হতে চায়, ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়, ফলে কোনো পক্ষই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না। তাই বহু ক্ষেত্রেই গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে।’
ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান হত্যাযজ্ঞকে গণগত্যা এবং এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনের অভিযোগ তুলে বর্ষিয়ান এই রাজনীতিবিদ বলেন, ‘গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ একপ্রকার গণহত্যা আর যুক্তরাষ্ট্র এর পেছনে থেকে সেটা চালিয়ে যেতে সহায়তা করছে। একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে ক্ষুধা ও যুদ্ধ ব্যবহার করা হচ্ছে, অথচ যুক্তরাষ্ট্র সেই অপরাধীদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেÑ এটা পশ্চিমা সভ্যতার পতনের প্রতিচ্ছবি। আমরা এমন এক সময় পার করছি, যেখানে মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে গেছে। মানুষ হয়ে আমরা এখন আবার বর্বরতায় ফিরে গেছি।’
এ ছাড়া বিশ^কে নেতৃত্ব দেওয়ার স্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন মালয়েশিয়ার সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। মাহাথিরের ভাষায়, ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন আর মানবাধিকারের কথা বলে না, মানুষের জীবন নিয়েও ভাবে না। বিশ্বে তারা আর নেতৃত্ব দেওয়ার উপযুক্ত নয়।’
মুসলিম বিশ্বের বিষয়ে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনের মতো ইস্যুতেও মুসলিম দেশগুলো একমত হতে পারে না। ওআইসি (ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা) সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু কেউ একজন আপত্তি করলেই কিছু করা যায় না। তাই তারা কিছুই করতে পারে না।’
নিজের কর্মময় দীর্ঘ জীবনের পেছনের রহস্য সম্পর্কে মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, ‘আপনি যদি প্রাণঘাতী কোনো রোগে আক্রান্ত না হন, তাহলে অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারবেন। তবে সুস্থ থাকতে হলে অতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া পরিহার করা উচিত।’
নিজের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি নিয়মিত শরীরচর্চা করি, মস্তিষ্কের ব্যায়াম করি। পড়াশোনা করি, লিখি, কথা বলি, বিতর্ক করি, নিজেকে সক্রিয় রাখি। আপনি যদি ভালো থাকতে চান, কাজের মধ্যে থাকতে চান, তাহলে আপনার শরীর ও মস্তিষ্ক সক্রিয় রাখার বিকল্প নেই।’
যদিও নিজের কর্মময় ও সুস্থ জীবনের পেছনে স্ত্রী সিতি হাসমাহের অবদানের কথাও কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেন তিনি।
মাহাথির মোহাম্মদ তার রাজনৈতিক জীবনের অর্জন ও সাফল্যের বিষয়ে নিজেই নিজের মূল্যায়ন করতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘আমি যা করেছি, সে বিষয়ে কথা বলবে সাধারণ মানুষ। তবে আমি আমার দেশের জন্য কাজ করতে পেরে আনন্দিত।’
আপনার মতামত লিখুন :