ঢাকার খুব কাছেই চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত কুমিল্লা জেলা প্রসিদ্ধ খাদি কাপড় ও রসমালাইয়ের জন্য। কুমিল্লা এমন একটি জায়গা যেখানে আপনি মধ্যযুগ থেকে শুরু করে মোঘল সম্রাজ্য, পাকিস্তান সময়ের কথাও জানতে পারবেন। বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন ও শিক্ষানগরী হিসেবে প্রসিদ্ধ এই জেলা। আছে অনেক দর্শনীয় স্থান। উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ স্থানের মধ্যে রয়েছে ময়নামতি ওয়্যার সিমেট্রি, ম্যাজিক প্যারাডাইস, ধর্মসাগর দীঘি, বার্ড, লালমাই পাহাড়, শালবন বৌদ্ধ বিহার, ফান টাউন, ডায়নো পার্ক এবং ব্লু ওয়াটার পার্ক। প্রতিদিন এখানে অসংখ্য মানুষের
আনাগোনা থাকে। বাস বা ট্রেনে ঢাকা হতে কুমিল্লা যেতে মাত্র দুই ঘণ্টা সময় লাগে। আর তাই ঢাকা থেকে একদিনের ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে কুমিল্লা অনেক জনপ্রিয়। আপনি যখন কুমিল্লা ঘুরবেন, ব্রিটিশ-পাকিস্তান সময়ের অনেক ইতিহাস আঁচ করতে পারবেন। মজার বিষয় হলো, দিনে এসে দিনে ঘুরে যেতে পারবেন কুমিল্লা থেকে। চলুন জেনে নেই একদিনে কুমিল্লা ভ্রমণের সকল তথ্য।
শালবন বৌদ্ধ বিহার
এক সময়কার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রধান উপাসনালয় শালবন বৌদ্ধ বিহারের অবস্থান কুমিল্লার কোটবাড়িতে। এখানকার বনে প্রচুর পরিমাণে শাল গাছ থাকায় স্বভাবতই বিহারটির নাম শালবন বিহার হয়েছে। বিহারে মোট ১৫৫টি কক্ষ আছে, যেখানে ধর্মচর্চা করতেন বুদ্ধের অনুসারীরা। এই বিহার থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রোঞ্জ ও মাটির মূর্তি, সিলমোহর, ৮টি তাম্রলিপি এবং অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা পাওয়া গেছে। কুমিল্লা সদর থেকে ২০ টাকা সিএনজি ভাড়ায় কোটবাড়ি বিশ্বরোড হয়ে সরাসরি শালবন বিহার যাওয়া যায়।
ময়নামতি জাদুঘর
কুমিল্লার ঐতিহাসিক নিদর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা এই ময়নামতি জাদুঘর, যার অবস্থান কুমিল্লা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে সালমানপুরে। জাদুঘরের ৪২টি ভিন্ন ভিন্ন সংরক্ষণাগার ঘুরে দেখার সময় চোখে পড়বে ব্রোঞ্জ ও পাথরের ছোট-বড় মূর্তি, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রোঞ্জের বিশাল ঘণ্টা, পোড়ামাটির ফলক, মাটির খেলনা, কাঠের পুরোনো জিনিসপত্র, মৃৎশিল্প সামগ্রী এবং প্রাচীন হাতে লেখা পা-ুলিপি। কুমিল্লার চারপত্র, রূপবান ও কোটিলা মুড়া, শ্রীভবদের মহাবিহার, ইটাখোলা, রানির বাংলো ও ভোজ রাজবাড়ি বিহার এবং আনন্দ বিহার খননকালে খুঁজে পাওয়া যায় এই প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। আঙিনার বিশ্রামাগার আর ফুল বাগান জাদুঘরের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ১৯৬৫ সালে কোটবাড়ির শালবন বিহারের পাশেই স্থাপন করা হয় এই জাদুঘর। পাশাপাশি হওয়ায় এক সঙ্গে দুটো স্থানই ঘুরে আসতে পারেন পর্যটকরা।
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শহিদ হওয়া ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার সৈনিকদের একটি আন্তর্জাতিক সমাধিক্ষেত্র এই ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি। ২৪ জন জাপানি যুদ্ধবন্দি ও একজন বেসামরিক ব্যক্তিসহ মোট ৭৩৭ জন সৈন্যের কবর আছে এই সমাধিক্ষেত্রে। কমনওয়েলথ পরিচালিত ওয়ার সিমেট্রিটির অবস্থান ময়নামতি সাহেব বাজার এবং কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের টিপরা বাজারের মধ্যস্থলে। প্রায় ৪ দশমিক ৫ একর পাহাড়ি ভূমির ওপর গড়ে তোলা ওয়ার সিমেট্রি বাংলাদেশের দ্বিতীয় কমনওয়েলথ সমাধিক্ষেত্র। স্থানীয় নিবাসীরা একে ইংরেজ কবরস্থান নামে ডাকলেও এখানে সমাহিত সৈন্যদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও ইহুদিও রয়েছেন। কুমিল্লা থেকে সিএনজি-অটোরিকশা কিংবা বাসে করে পৌঁছা যায় ময়নামতির এই যুদ্ধের গোরস্তানে।
ধর্মসাগর দীঘি
কুমিল্লা সদরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই দর্শনীয় স্থানটি। আঙিনায় ঢুকতেই দেখা যায় একটি সাইন বোর্ড, যেখানে লেখা আছে এই দীঘির ইতিহাস। ১৭৫০-১৮০৮ সালে রাজা ধর্মপালের শাসনামলে রাজ্যে এক ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখন পাল বংশের এই জনদরদী রাজা প্রজাদের কষ্ট দূর করার জন্য খনন করে দেন ধর্মসাগর দীঘিটি। অতঃপর তার নামেই দীঘিটি প্রসিদ্ধি লাভ করে। দীঘির উত্তরে সবুজে ঘেরা শিশুপার্ক থেকে ধর্মসাগরের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। পর্যটকদের কেউ ধর্মসাগরের পাড় ধরে হেঁটে বেড়ান, কেউ বা নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়ান দীঘির জলে। কুমিল্লার শাসনগাছা থেকে স্থানীয় যেকোনো যানবাহন নিয়ে বাদুরতলা পর্যন্ত গেলেই দেখা যাবে ধর্মসাগর।
আনন্দ বিহার
কোটবাড়ির ময়নামতিতে অবস্থিত
স্থাপনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এই বিহারটি ছিল উপমহাদেশের সর্বশেষ বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়। এটি নির্মাণ করেছিলেন দেব রাজবংশের তৃতীয় শাসক শ্রী আনন্দ
দেব সপ্তম অথবা অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে। ধারণা করা হয়, সপ্তম শতকের শেষ সময়ে এই বিহার ছিল সমতটের রাজধানী। নান্দনিক বর্গাকৃতির বিশাল অবকাঠামোর ঠিক মাঝখানে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দির এবং অপরূপ এক দীঘি। কুমিল্লা সদর থেকে কোটবাড়ির আনন্দ বিহার যাবার
পথে বিখ্যাত টমছম ব্রিজ দেখে নেওয়া যেতে পারে।