‘রাজার পাহাড়’ নাম শুনেই মনে হতে পারে, হয়তো কোনো রাজা বাস করেন এই পাহাড়ে। কথিত আছে, অনেক আগে এখানে এক স্বাধীন রাজা ছিলেন। সেই রাজাকে ঘিরেই পাহাড়ের এই নামকরণ। শেরপুর শহর থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দূরে শ্রীবরদী উপজেলায়, ভারতের মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা এলাকায় কর্ণঝোড়া বাজারের কাছেই, ঢেউফা নদীর তীরে রাজার পাহাড়ের অবস্থান। পাহাড়টি গারো পাহাড়শ্রেণির মধ্যে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়গুলোর একটি। এই পাহাড়ে উঠলে চোখে পড়ে বিশাল সবুজ টিলা। সমতল চূড়া থেকে দূরদিগন্ত পর্যন্ত পাহাড়, নদী ও সীমান্ত এলাকার দৃশ্য চোখে পড়ে। পাহাড়ের উপরে উঠলে আপনার মনে হবে যেন আকাশের গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
পাহাড়ে যাওয়ার পথে পথচারীকে স্বাগত জানায় সবুজ লতা-পাতা, গুল্ম আর ঔষধি গাছ। এ ছাড়া পথের দু’ধারে আছে নানা ধরনের গাছপালা। অনেক গাছেই দেখা যায় ছোট পাখির বাসা, তাদের কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। এমন নিরিবিলি পরিবেশে হাঁটলে মনে হবে, শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে চলে এসেছেন। রাজার পাহাড়ের চূড়ায় কিছু সমতল ভূমি আছে; যেখানে স্থানীয়রা চাষাবাদ করেন। এখানে চাষ হয় মাল্টা, লেবু, পেঁপে, করলা, মরিচ, চিচিঙ্গা কিংবা জলপাই। কেউ আবার গবাদিপশু চড়ান খোলা জায়গায়। এখানে মানুষের আনাগোনা তুলনামূলকভাবে কম, তাই চাষাবাদ বা পশুপালনের জন্য বেশ উপযোগী পরিবেশ।
পাহাড় থেকে স্পষ্ট দেখা যায় আশপাশের গ্রামের দৃশ্য। কর্ণঝোড়া, মালাকোচা, দিঘলাকোনা, বাবেলাকোনা, হারিয়াকোনা এবং আরও কয়েকটি সীমান্তঘেঁষা গ্রাম চোখে পড়ে। নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে ঢেউফা নদী, যেটি বর্ষাকালের জোয়ারে কানায় কানায় ভরে যায়। আবার ভাটার সময় পানি নেমে যায় তলানিতে। বছরের বেশিরভাগ সময়েই এই নদী হেঁটে পার হওয়া যায়। নদীর দুই পাশে এখন সেতু নির্মাণ হওয়ায় যোগাযোগ আরও সহজ হয়েছে। নদীর মাঝ বরাবর বিস্তীর্ণ বালুচর; এখানকার বালু এলাকার মানুষ নির্মাণকাজের জন্য শহরে বয়ে নিয়ে যায়। রাজার পাহাড়ের খুব কাছেই বাবেলাকোনা নামের একটি গ্রাম আছে। এই গ্রামের পরিবেশও মনোরম। এখানে গারো, হাজং, কোচসহ বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস। তাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি আলাদা হলেও সবার মধ্যে একধরনের সামঞ্জস্যতা আছে। এই জনপদে রয়েছে কালচারাল একাডেমি, আদিবাসীদের জাদুঘর, গবেষণা বিভাগ ও লাইব্রেরি। এখান থেকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। বাবেলাকোনায় আছে মিশনারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। পাহাড়ের কাছেই রয়েছে বিজিবি ক্যাম্প, বিট অফিস, কারিতাস ও রাবার বাগান। সব মিলিয়ে এখানকার পরিবেশকে ঘিরে এক ধরনের স্বাভাবিক গ্রামীণ জীবন গড়ে উঠেছে।
যেভাবে যাবেন-
ঢাকা থেকে শেরপুরের সড়ক যোগাযোগ খুবই ভালো। শেরপুর শহর থেকে রাজার পাহাড় যেতে হলে, প্রথমে খোয়ারপাড় থেকে সিএনজিতে শ্রীবরদী, তারপর সেখান থেকে অটোতে কর্ণঝোড়া বাজারে যেতে হবে। বাজার থেকে হেঁটে বা ভ্যানে রাজার পাহাড়ে যাওয়া যায়। যেতে যেতে চোখে পড়বে কর্ণঝোড়া সেতু, তার পাশেই রয়েছে বিট অফিস। রাজার পাহাড় দেখা শেষে চাইলে আপনি বাবেলাকোনা ঘুরে আসতে পারেন। পাহাড় থেকে বাবেলাকোনা ২ কিলোমিটার দূরে। পশ্চিম দিকে আরও ৩ কিলোমিটার গেলেই দেখতে পাবেন লাউয়াচাপড়া পর্যটন কেন্দ্র।
থাকার জায়গা
রাজার পাহাড় ঘুরতে গিয়ে রাতে থেকে যাওয়ার প্রয়োজন হলে বন বিভাগের ডাকবাংলোতে থাকতে পারেন। এ ছাড়া লাউয়াচাপড়ার বনফুল রিসোর্টে থাকা যায়, সেক্ষেত্রে খরচ একটু বেশি হবে। কম খরচে থাকতে চাইলে শ্রীবরদী উপজেলার ডাকবাংলো একটি ভালো বিকল্প, তবে সেখানে থাকতে হলে আগে থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমতি নিতে হয়। শেরপুর শহরে হোটেল সম্পদ, হোটেল কায়সার ইনসহ কয়েকটি আবাসিক হোটেল আছে, যেখানে নিরাপদে রাত কাটানো যায়।
খাওয়ার ব্যবস্থা
শেরপুর শহরে ভালো খাবারের ব্যবস্থাও রয়েছে। নিউমার্কেট এলাকায় হোটেল শাহজাহান, হোটেল স্টার, হোটেল আহার বা হোটেল প্রিন্সে খেতে পারেন। এখানকার বিখ্যাত খাবার ‘ছানার পায়েস’ অবশ্যই খেয়ে দেখা উচিত। এরই মধ্যে শেরপুরের ছানার পায়েস বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শহরের অনুরাধা, চারু মিষ্টান্ন সুইটস, নন্দ গোপালের ছানার পায়েস খুবই জনপ্রিয়। একদিন সময় নিয়ে গেলে রাজার পাহাড়, বাবেলাকোনা এবং আশপাশের অঞ্চল ঘুরে দেখা যায়। সময় বেশি থাকলে লাউয়াচাপড়া, গজনী অবকাশ, মধুটিলা ইকোপার্ক, পানিহাটা বা তারানি পাহাড়ও দেখতে পারেন।