বাংলাদেশের বাগেরহাটে অবস্থিত নয় গম্বুজ মসজিদ একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক স্থান। খান জাহান আলীর পৃষ্ঠপোষকতায় পনেরো শতকের নির্মিত এই মসজিদটি বৃহত্তর বাগেরহাট মসজিদ সিটির অংশ এবং ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। মসজিদের নামটি এর স্বতন্ত্র নয় গম্বুজ ছাদের কাঠামো থেকে এসেছে, যা চারটি কেন্দ্রীয় পাথরের স্তম্ভ দ্বারা সমর্থিত। প্রতিটি গম্বুজ নিখুঁতভাবে সারিবদ্ধ; যা সেই সময়ের স্থাপত্য দক্ষতা প্রদর্শন করে। নয় গম্বুজ মসজিদটি জটিল পোড়ামাটির অলঙ্করণে সজ্জিত, যা বাংলার ইসলামি শিল্পের বৈশিষ্ট্য।
মিহরাব বা প্রার্থনা কুলুঙ্গি বিস্তৃত নকশার জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মসজিদটিতে একাধিক প্রবেশদ্বারও রয়েছে; যার মধ্যে পূর্ব দিকের প্রবেশদ্বারটি সবচেয়ে বিশিষ্ট। এর অভ্যন্তর এবং চারপাশের ভূমি একটি শান্ত পরিবেশ তৈরি করে, যা এটিকে একটি শ্রদ্ধেয় উপাসনালয় এবং একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করে। ইটের তৈরি বর্গাকৃতির মসজিদটি পরিমাপে বাইরের দিকে প্রায় ১৬.৭৬ মিটার এবং ভেতরের দিকে ১২.১৯ মিটার।
উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব তিন দিকের প্রাচীরই ২.৪৪ মিটার পুরু। ভেতরে প্রবেশের জন্য তিনটি করে খিলানপথ আছে। মাঝের খিলানপথটি একটি আয়তাকার কাঠামোয় সন্নিবেশিত এবং পার্শ্ববর্তী খিলানগুলো অপেক্ষা বড়। প্রতি সারিতে দুটি করে মোট দুই সারি পাথর নির্মিত স্তম্ভ দ্বারা মসজিদের অভ্যন্তর তিনটি আইল ও তিনটি ‘বে’তে বিভক্ত। ফলে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নয়টি ‘বে’ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি ‘বে’ উল্টানো কাপ আকৃতির গম্বুজ দ্বারা আবৃত। গম্বুজই মসজিদ অভ্যন্তরে পরস্পর ছেদ করা চারটি খিলানের ওপর তাদের ভার ন্যস্ত করেছে, যেগুলো পাথর স্তম্ভ ও প্রাচীর সন্নিবেশিত স্তম্ভ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। গম্বুজগুলো প্রাচীরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে বাংলা পেন্ডেন্টিভ-এর মাধ্যমে। কিবলা প্রাচীরে ভাঁজযুক্ত খিলানবিশিষ্ট তিনটি মিহরাব রয়েছে, যেগুলো পূর্ব প্রাচীরের খিলানপথের অক্ষ বরাবর অবস্থিত। খিলানপথের মতোই এখানেও মাঝের মিহরাবটি পার্শ্ববর্তী মিহরাবদ্বয় অপেক্ষা বড় এবং বাইরের দিকে অভিক্ষিপ্ত।
পাথরের স্তম্ভ, যা গম্বুজাবৃত ছাদের ভার বহন করছে, চতুষ্কৌণিক স্তম্ভভিত্তি ও স্তম্ভশীর্ষ সমৃদ্ধ। স্তম্ভগুলো অষ্টভুজাকৃতির এবং পেডেস্টাল ও ক্যাপিটাল থেকে একে বন্ধনী দ্বারা পৃথক করা হয়েছে। প্রাচীর সন্নিবেশিত স্তম্ভ গুলিতেও চতুষ্কৌণিক ভিত্তি ও ক্যাপিটাল রয়েছে। খান জাহানী রীতিতে গঠিত গোলাকৃতির বুরুজ অভ্যন্তরের চার কোণকে মজবুত করেছে। ছাদ সমান উচ্চতার এ বুরুজগুলো ‘মোল্ডেড’ ভিত্তি এবং সমান উপরিতল সমৃদ্ধ। কার্নিশগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সামান্য বাঁকানো।
পোড়ামাটির শ্রমলব্ধ অলংকার-কর্ম বর্তমানে কেবল খিলানপথ, মিহরাব, বুরুজ ও কার্নিশের মধ্যেই তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। খিলানপথকে সন্নিবদ্ধকারী বাইরের দিকের আয়তাকার কাঠামো জাল নকশায় সমৃদ্ধ। খিলানপথগুলোর মধ্যবর্তী উলম্ব সংকীর্ণ ফাঁকা জায়গার ভিত্তিতে একজোড়া লজেন্স নকশা রয়েছে। মোল্ডিং-এর মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা গোলাপ নকশায় ও মাঝে মাঝে বুটিদার ও ছোট গোলাপ সমৃদ্ধ প্যাঁচানো নকশা সমৃদ্ধ।
ভবন অভ্যন্তরে সবগুলো খিলানপথের স্প্যান্ড্রেল বিশালাকৃতির প্রস্ফুটিত পদ্মশোভিত। অন্যদিকে খিলানগুলোর সম্মুখভাগের কেন্দ্রবিন্দু বিশাল লজেন্স নকশা দ্বারা অলংকৃত। লজেন্সগুলোর সীমানা আবার গোলাপ নকশা দ্বারা শোভিত। সারিবদ্ধ ছোট গোলাপ নকশা ও পদ্মপাতা সমৃদ্ধ তিনটি মোল্ডেড ব্যান্ড প্রতিটি খিলানপথের শীর্ষালংকরণে ব্যবহূত হয়েছে। ব্যান্ডের মধ্যবর্তী সংকীর্ণ জায়গাটি নেকলেস, প্যাঁচানো লতা ও ফুল নকশাশোভিত।
মিহরাবগুলোও অসাধারণ অলংকরণে সমৃদ্ধ। কেন্দ্রীয় মিহরাবটির স্প্যান্ড্রেল ফুলের মোটিফ সমৃদ্ধ। মিহরাবের উপরিভাগের দুটি মোল্ডেড ব্যান্ডের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা আঙুর ও আঙুরলতা নকশাশোভিত। গোলাকৃতির মিহরাব কুলুঙ্গি অনুভূমিক সরু প্যানেল দ্বারা উপস্থাপিত। প্যানেলগুলো আবার উত্তোলিত অলংকৃত ব্যান্ড দ্বারা ভাগ করা হয়েছে। অলংকরণের মোটিফ এক-এক প্যানেলে এক-এক রকম এবং নেকলেস নকশা, পদ্ম, তালপত্র ও বিভিন্ন রকমের ইন্টারলকিং নকশায় সমৃদ্ধ।
মিহরাব কুলুঙ্গিটি উপরের অর্ধ গম্বুজের শীর্ষ থেকে নেমে আসা একটি শিকল দ্বারা বিভক্ত। শিকলটি শেষ হয়েছে একটি আয়তাকার পেন্ডেন্টে, যদিও এখন তা অনুপস্থিত। যে আয়তাকার ফ্রেমের মাঝে মিহরাব কুলুঙ্গি সন্নিবেশিত তা পরস্পরযুক্ত গোলাপ নকশায় সমৃদ্ধ। ফ্রেমের উপরে অত্যন্ত বলিষ্ঠ দুটি ব্যান্ড অভিক্ষিপ্ত এবং এগুলো সারিবদ্ধ গোলাপ নকশাশোভিত। সমস্ত অবকাঠামোটির শোভাবর্ধনে অসাধারণভাবে সহযোগিতা করেছে এর অলংকৃত শীর্ষচূড়া।
নির্মাণশৈলীর দিক থেকে মসজিদটি খান জাহানের সময়ের। স্থানীয় জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, খান জাহানের কোনো এক কর্মকর্তা মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।
আপনি যদি খুলনা বাগেরহাটে ভ্রমণ করেন তবে অবশ্য আপনাকে এই মসজিদটি দেখে যেতে হবে; এখানে আছে পনেরো শতকের অনেক না বলা গল্প। সেই সময়ে এই দেশে ইসলাম প্রচারের একটি বাস্তব নিদর্শন এই নয় গম্বুজ মসজিদ।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন