‘আমার ছেলে তুহিন কালকে (বুধবার) বলেছে, ‘আমি তোমাকে আগামী মাসে চোখের ডাক্তার দেখাব। ডাক্তার অপারেশন করানোর কথা বললে, অপারেশন করাব। আম্মা, কোনো চিন্তা করো না। তুমি ভালো হয়ে যাবে।’ — বুক চাপড়ে আহাজারি করতে করতে এসব কথা বলছিলেন গাজীপুরে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের ৭৫ বছর বয়সি মা সাবিহা খাতুন।
সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার ৬ নম্বর ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের ভাটিপাড়া গ্রামের মো. হাসান জামাল ও সাবিহা খাতুন দম্পতির ছেলে। তুহিন পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট। তার স্ত্রীর নাম মুক্তা আক্তার। তাদের সংসারে দুই ছেলে— বড় তৌকির (৭) এবং ছোট ফাহিম (৩)।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাতে গাজীপুরে সন্ত্রাসীদের হাতে সাংবাদিক তুহিনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে, সকাল থেকেই আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা তার গ্রামের বাড়ি ভাটিপাড়া আসতে শুরু করেন। শুক্রবার (৮ আগস্ট) বেলা ১২টার দিকে ভাটিপাড়া গ্রামে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়।
ছেলের মৃত্যুসংবাদে পাগলপ্রায় বৃদ্ধ বাবা মো. হাসান জামাল ক্ষণে ক্ষণেই মূর্ছা যাচ্ছেন। আহাজারি করতে করতে বললেন, ‘কী অপরাধ করেছিল আমার ছেলে? কী অন্যায় করেছিল সে? কেন এমন হলো? আমি খুনিদের চাই না, তোমরা আমার ছেলেকে এনে দাও।’
বোন সাইদা আক্তার রত্না বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমাদের খোঁজখবর নিত। আমার ভাই কোনোদিন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। কখনো খারাপ ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিত না। কেন আমার ভাইকে হত্যা করা হলো? আমার ভাইয়ের কী অপরাধ ছিল? আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে, তাদের ফাঁসি চাই।’ —এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
স্বজনদের বরাতে জানা যায়, আসাদুজ্জামান তুহিন ২০০৫ সালে ফুলবাড়িয়া আল হেরা স্কুল থেকে এসএসসি, ২০০২ সালে সিলেট এম. সাইফুর রহমান কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করার পর গাজীপুর ভাওয়াল কলেজ থেকে অনার্স করেন।
পরে ভাই জসিম উদ্দিনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন এবং কিছুদিন ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। ২০১২ সালে সংবাদপত্রে কাজ শুরু করেন এবং চাকরি ছেড়ে দেন। তবে ২০০৯ বা ২০১০ সালের দিকে হঠাৎ বড় ভাই জসিম ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
বর্তমানে তুহিন ও তার আরেক ভাই সেলিম গাজীপুরে বসবাস করতেন। সেলিম পরিবহণ শ্রমিকের কাজ করেন। দ্বিতীয় ভাই জাহাঙ্গীর আলম পরিবার নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে বসবাস করেন এবং আরেক ভাই শাজাহান মিয়া সিলেটে থাকেন। দুই বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে গ্রামের বাড়িতে সঙ্গহীন জীবন কাটাচ্ছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। তারা বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছেন, আর ছেলেরাই তাদের দেখাশোনা করতেন।
গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় বাদ জুমা তুহিনের প্রথম জানাজা শেষে গ্রামের বাড়ি আনা হবে। এরপর মাগরিব বাদ দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে গাজীপুর নগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এক ব্যক্তিকে ধাওয়া করছিল। সাংবাদিক তুহিন সেই দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করছিলেন। তখন তাকে ধাওয়া করে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থলের একটি দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
তুহিনের সহকর্মী শামীম হোসেন বলেন, ‘চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় আমরা দুজন এক দিক থেকে অন্যদিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় একজন নারী ও একজন পুরুষ আমাদের পাশ কাটিয়ে যান। তখন কয়েকজন লোক ধারালো অস্ত্র নিয়ে বলতে থাকে, ‘এই পাইছি, তোরা আয়।’ ওই ব্যক্তি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তারা অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করলে তুহিন মোবাইল বের করে ভিডিও ধারণ শুরু করে তাদের পেছনে দৌড়ান।
তিনি আরও বলেন, ‘পরে আমি তুহিনকে খুঁজতে গেলে দেখি, অস্ত্রধারীরা হঠাৎ থেমে পেছনে তাকায়। তুহিন তখন দৌড়ে চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই ওরাও দোকানে ঢুকে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। এরপর আমি পুলিশের গাড়ি খুঁজতে থাকি, না পেয়ে বাসন থানার ওসিকে ফোন করি। কিছু সময় পর পুলিশ আসে।’
ঘটনার পর রাতেই নিহত তুহিনের বড় ভাই মো. সেলিম ও আরেকজন বাদী হয়ে বাসন থানায় দুটি মামলা দায়ের করেন। বাসন থানার ওসি শাহীন খান বলেন, ‘আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। অপরাধে জড়িত প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হবে।’
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (ক্রাইম-উত্তর) মো. রবিউল হাসান বলেন, ‘আমাদের ধারণা, একজনকে মারধরের ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় তুহিনকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে।’