মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে শ্রমিকদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে আরও পাঁচটি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এই পাঁচ এজেন্সির বিরুদ্ধে আনুমানিক ৩১৪ কোটি ৩৪ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে মোট ২৬ জনকে আসামি করে পাঁচটি পৃথক মামলা করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) দুপুরে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, অভিযুক্ত এজেন্সিগুলো মোট ১৮ হাজার ৭৬৭ জন কর্মীর কাছ থেকে সরকারের নির্ধারিত সর্বোচ্চ ফির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে।
আক্তার হোসেন বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত ফি ছিল ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা, কিন্তু কিছু অসাধু এজেন্সি প্রতিজন শ্রমিকের কাছ থেকে চার থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত অর্থ নিয়েছে। এতে হাজার হাজার শ্রমিক প্রতারিত হয়েছেন এবং কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আত্মসাৎ হয়েছে।’
পাঁচ মামলার বিস্তারিত
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, নতুন অনুমোদিত পাঁচটি মামলার বিবরণ নিচে দেওয়া হলো:
১. জিএমজি ট্রেডিং (প্রা.) লিমিটেড
এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ২ হাজার ৮৩০ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ৪৭ কোটি ৪০ লাখ ২৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত নিয়েছে। এ ঘটনায় কোম্পানির চেয়ারম্যানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা অনুমোদন করেছে দুদক।
২. দ্য জিএমজি ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েট
এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ৩ হাজার ২৩৯ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ৫৪ কোটি ২৫ লাখ ৩২ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে সরকারের নির্ধারিত ফি উপেক্ষা করে। চেয়ারম্যান, পরিচালকসহ মোট সাতজনকে আসামি করা হয়েছে।
৩. কিউকে কুইক এক্সপ্রেস লিমিটেড
এই কোম্পানি ২ হাজার ২৭৫ জন কর্মীর কাছ থেকে ৭১ কোটি ৬০ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা আদায় করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মামলায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), চেয়ারম্যানসহ সাতজনকে আসামি করা হয়েছে।
৪. এমইএফ গ্লোবাল বাংলাদেশ (প্রথম মামলা)
এজেন্সিটি ৪ হাজার ৫৬৬ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ৭৬ কোটি ৪৮ লাখ ৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত আদায় করেছে। এ ঘটনায় এমডি, চেয়ারম্যানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
৫. এমইএফ গ্লোবাল বাংলাদেশ (দ্বিতীয় মামলা)
এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আগে আরেকটি মামলায় অভিযোগ রয়েছে, ৩ হাজার ৮৫৭ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ৬৪ কোটি ৬০ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হয়েছে। এ মামলাতেও তিনজন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, এ নিয়ে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর নামে প্রতারণার ঘটনায় একের পর এক মামলা হচ্ছে। এর আগে গত ৬ নভেম্বর ছয়টি এজেন্সির ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এবং ১১ নভেম্বর চারটি এজেন্সির পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আরও আগে, ১৪ সেপ্টেম্বর একই ধরনের অভিযোগে ১৩টি রিক্রুটিং এজেন্সির কর্তা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের হয়।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্তে এখন পর্যন্ত প্রমাণ মিলেছে যে, এসব এজেন্সি সরকারের নির্ধারিত সীমা ভঙ্গ করে প্রতিজন শ্রমিকের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা আদায় করেছে। তারা শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে ওই অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে, যার বড় অংশ অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
২০১৮ সালে মালয়েশিয়া বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ করে দেয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয় শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও ব্যাপক দুর্নীতি। দীর্ঘ তিন বছর বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর দুই দেশের মধ্যে নতুন সমঝোতা চুক্তি (MoU) স্বাক্ষরিত হয়। ওই সময় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় শ্রমিক পাঠানোর সর্বোচ্চ ফি নির্ধারণ করে ৭৮ হাজার ৫৪০ টাকা।
তবে বাস্তবে বেশিরভাগ রিক্রুটিং এজেন্সি এই নির্দেশনা মানেনি। হাজার হাজার শ্রমিকের কাছ থেকে দুই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন, কেউ কেউ বিদেশে গিয়েও প্রতিশ্রুত চাকরি পাননি।
দুদকের মহাপরিচালক বলেন, ‘এই প্রতারণার মাধ্যমে শুধু আর্থিক ক্ষতিই হয়নি, দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হয়েছে। বিদেশে কর্মসংস্থানের নামে শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না।’
তিনি আরও জানান, দুদক ইতোমধ্যে আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। প্রমাণ মিললে নতুন মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর নামে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের ঘটনায় মোট ২৭টিরও বেশি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ৫০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা।
দুদক বলছে, বিদেশে কর্মসংস্থানের নামে এ ধরনের প্রতারণা বন্ধে কঠোর নজরদারি অব্যাহত থাকবে এবং দায়ীদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না





