বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মে ১৩, ২০২৫, ০৭:০০ পিএম

ঘুরে এলাম বিস্ময়কর গ্রাম ‍‍‘হুলহুলিয়া‍‍’

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মে ১৩, ২০২৫, ০৭:০০ পিএম

ঘুরে এলাম বিস্ময়কর গ্রাম ‍‍‘হুলহুলিয়া‍‍’

মডেল ও স্মার্ট ভিলেজ হুলহুলিয়া। ছবি-রূপালী বাংলাদেশ

নাটোরের বিস্ময়কর গ্রাম ‘হুলহুলিয়া’। মডেল ও স্মার্ট ভিলেজ হুলহুলিয়া ঘুরে আসার মধ্য দিয়ে আরেকটি অপূর্ণ ভ্রমণ-তৃষ্ণা শেষ পর্যন্ত পূরণ হলো।

অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় এই গ্রামের কথা আমি প্রথম যেদিন শুনেছিলাম, সেদিনই ঠিক করে ফেলেছিলাম আমি এই গ্রামে একবার যাবই।

আমাদের বিয়ের পরে জেনেছি, আমার স্ত্রীর ফুফাতো বোন রেনু আপার বিয়ে হয়েছে ওই গ্রামে। হুলহুলিয়া গ্রাম দেখার সুবাদে রেনু আপা ও দুলাভাইয়ের বাসায় বেড়াতে যাওয়া হবে। 

যাত্রা শুরু

আমাদের পরিকল্পনা ছিল কোনো এক শনিবার (ছুটির দিন) হুলহুলিয়া গ্রামে যাব। সে মোতাবেক বাউয়েটের অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) মো. সেলিম রেজা, এডমিশন সহকারী ইনফরমেশন অফিসার মো. নাজমুল ইসলাম উজ্জ্বল ও তার বন্ধু ঈশ্বরদী মহিলা কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক তনয় বেরিয়ে  পড়লাম।

বনপাড়া থেকে তিরাইল মৌখাড়া, নাজিরপুর হয়ে সোজা বিলদহর বাজার। বিল বিলদহরের বৈকালিক মাছের বাজারটা ঘুরে দেখার একটু ইচ্ছা ছিল। সেটাও পূরণ হলো মাছ বাজারে গিয়ে।

সিংড়ার চলনবিলের তরতাজা বোয়াল, সোল, চিতল, শিং মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ দেখলাম। তবে কেনা হলো না।  

এরপর রওনা হলাম আত্রাই নদী ও গুড়নাই নদীর মিলিতস্থল ত্রিমোহনী। ভৌগোলিক পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘দোয়াব’ আর স্থানীয়ভাবে বলে ত্রিমোহনী।

ত্রিমোহনী ব্রিজে কিছু সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি। স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল  ত্রিমোহনীতে সুতি জালের মাধ্যমে প্রচুর মাছ ধরা  হয়।  

স্থানীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার ও মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে মধ্যে সংঘর্ষ হয়, আবার মিটে যায়। ত্রিমোহনী থেকে নূরপুর বাজার হয়ে সিংড়া বাসস্ট্যান্ড বাজারে খাওয়া বিরতি। একটি হোটেলে দুপুরের খাওয়া খেয়ে রওনা হই হুলহুলিয়ার উদ্দেশে।

অবস্থান

নাটোরের সিংড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে চৌগ্রামের পশ্চিমে শান্তিময় এক গ্রাম হুলহুলিয়া। হুলহুলিয়া গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ল হুলহুলিয়া শতভাগ শিক্ষিত মডেল ও স্মার্ট ভিলেজ গেট।

গেট পার হয়ে বাম পাশে নজরে আসলো হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ ভবন। বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ  চলছে। সন্ধ্যা  হয়ে আসার  কারণে বেশি দেরি না করে মূল গ্রামের ভেতর ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত হলো।

আমরা সন্ধ্যার আগে গিয়ে পৌঁছলাম হুলহুলিয়া গ্রামের হুলহুলিয়া স্কুলের সামনে। বসা পেলাম মধ্যবয়সী ও প্রৌঢ় কয়েকজন মুরব্বি। আমাদের যেতে দেখেই তারা খোঁজখবর নিলেন। পরিচয় হলো মির্জা পরিবারের মির্জা হান্নানের সঙ্গে। 

মির্জা পরিবারের সন্তান অধ্যাপক ড. মির্জা আফম রশিদুল হাসান হেলালের চাচা তিনি। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিই বিভাগের প্রধান এবং তার স্ত্রী অধ্যাপক ড. রুবাইয়াত ইয়াসমিন একই বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষক।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তারা দু’জন বাউয়েটের খণ্ডকালীন শিক্ষক এবং দুটি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক ড. মির্জা আ ফ ম রশিদুল হাসান হেলাল সিএসই এবং অধ্যাপক ড. রুবাইয়াত ইয়াসমিন সেবা আইসিই বিভাগের প্রধান ছিলেন।

তারা দায়িত্ব পালনকালে বিভাগের উন্নয়ন ও সুনামের জন্য আন্তরিকভাবে পরিশ্রম করেছেন। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আগেই বলেছিলাম রেনু আপার বিয়ে হয়েছে হুলহুলিয়া গ্রামে।

দুলাভাই সাব-রেজিস্ট্রার, ঢাকাতেই অবস্থান। তবু খুঁজে বের করলাম রেনু আপার বাসা। বাসায় কেউ নেই, গেট তালামারা থাকে। দুই ঈদে আসেন। ঘরবাড়ি ঝাড়ফুঁক করে ঈদ কাটিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে যায়।

যার ফলে তাদের কারো সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবু খুঁজে বের করেছি তাদের বাসা। বাসার দক্ষিণে বিশাল বড় দিঘি। শান বাঁধা দিঘির পাড়ে কিছু সময় কাটিয়ে চলে আসি হাইস্কুলের সামনে।

এরই মধ্যে খবর হয়ে গেল গ্রামে মেহমান এসেছে। আমরা মাগরিবের নামাজ পড়লাম হুলহুলিয়া হাইস্কুল সংলগ্ন মসজিদে। নামাজ পড়ে গ্রাম থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু বাধ সাধলেন হুলহুলিয়া গ্রামের সমাজ উন্নয়নের বর্তমান সভাপতি মো. আমিনুর রহমান।

তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তবেই যাওয়ার অনুমতি মিলবে। তিনি দাওয়াত করলেন সমাজ উন্নয়ন পরিষদ ভবনে যাওয়ার জন্য। সেখানে তিনি সংক্ষেপে আমাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে কিছু তথ্য প্রদান করবেন। 

শেষ রক্ষা হয়নি

আমরা সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেই হেলাল স্যারের চাচা জানালেন আপনাদের কিছু নাস্তা না করে যেতে দেওয়া হবে না। হেলাল স্যারের নির্দেশ। তিনি ফোন করে বললেন, ‘আপনি এবং আপনার টিম অবশ্যই আমাদের পৈতৃক বাড়িতে পদধুলি দিয়ে যাবেন।’

পড়ে গেলাম আরেক বিপদের মধ্যে। স্যার নিজেও বাসায় নেই। ওনার মেজো ভাই (বেলাল ভাই) জরুরি পারিবারিক কাজে নন্দীগ্রাম গিয়েছেন। আমাদের আসার খবর পেয়ে তিনি তড়িঘড়ি করে চলে আসেন।  

আয়োজন করেছেন বিভিন্ন রকমের নাস্তার। অনেকটা এমন যেন- ‘পড়েছ মোঘলের হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে।’

অগত্যা আমি হান্নান চাচার সঙ্গে গিয়ে হাজির হলাম মির্জা হেলাল স্যারের বাসায়।

বৈঠকখানার ওপরে নজর পড়তেই দেখলাম বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি  অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বাউয়েট) ভর্তির ব্যানার। দেখে মনে হলো অনেকদিন ধরে ঝোলানো। কিন্তু কেন? পরে মনে হলো নাটোরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নাটোরের অধিবাসী অধ্যাপকের আন্তরিকতার একটা খণ্ডচিত্র এটা। তাদের দু’জনের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং আন্তরিকতা দুটোই আমরা দেখতে পেয়েছি এখানে এসে।

ফিরে দেখা

১৯৪০ সালে এই গ্রামে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ নামে একটি সংগঠন কাজ শুরু করে গ্রামের মানুষদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থেকে শুরু করে ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসা ও সবরকম সামাজিক সমস্যার সমাধানে কাজ করে আসছে সংগঠনটি। হুলহুলিয়া গ্রাম ১৩টি পাড়া নিয়ে গঠিত।

এই গ্রামের আয়তন প্রায় দুই বর্গ কিলোমিটার। দেশের আর আট-দশটা গ্রাম থেকে এখানকার চিত্র একদমই আলাদা। যেখানে শিক্ষার হার শতভাগ। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত এই গ্রামের কেউ খুব একটা মামলা-মোকদ্দমায় জড়ায়নি।

বাল্যবিবাহ যৌতুক ও মাদকের মতো সামাজিক সমস্যা নেই। এই গ্রামের প্রতিভাবান সন্তানদের মধ্যে রয়েছেন সহস্রাধিক প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ ও আইনবিদসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধি।

নির্বাচন পদ্ধতি

গ্রাম পরিচালনা করার জন্য দুই বছর পরপর গ্রামবাসীর ভোটের মাধ্যমে হুলুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের ২৩ জন সদস্য নির্বাচিত হন। সদস্যের মধ্যে একজন থাকেন চেয়ারম্যান আর একজন ভাইস চেয়ারম্যান।

বাকি ২১ জন সদস্য হিসেবে থাকেন। এই বিচারক প্যানেলের মাধ্যমে বিচার করা হয় গ্রামবাসীর। ছোট ছোট অপরাধ ও গ্রামবাসীদের মধ্যে নিজস্ব ঝামেলা বা জমি নিয়ে বিরোধ গ্রামেই মিটিয়ে ফেলা হয়। ফলে গ্রামবাসীর আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

এই গ্রামে গত ১০০ বছরে কোনো পুলিশ আসেনি। আসার প্রয়োজন হয়নি। এটা অত্যন্ত অসাধারণ একটা বিষয়। কারণ বাংলাদেশে এরকম গ্রাম খুঁজে পাওয়া  দুষ্কর যে, গ্রামে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কোনো পুলিশ প্রবেশ করেনি।

এই গ্রামে অরাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে। একটি হচ্ছে শিকড়, আরেকটি হচ্ছে বটবৃক্ষ। এই দুটি সংগঠনের সদস্যরা এই গ্রামের অভাবী, গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার খরচ বহন করেন। বাংলাদেশের সব গ্রাম যদি এমন হতো, তাহলে বাংলাদেশের চিত্র পুরোটাই পাল্টে যেত।

সভাপতি মো. আমিনুর রহমান গ্রাম আদালত চত্বরে মতবিনিময়ের পরে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের ভবনটির ঘুরে দেখান। নিচতলায় বেশকিছু স্বনামধন্য ব্যক্তিদের পোস্টার এবং সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হয়েছে।

উপরের তলায় বিবাহ আয়োজনের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। অতিথিদের রাত্রিযাপনের জন্য সুব্যবস্থা রয়েছে।  

এবার বিদায়ের পালা

‘যেতে নাহি দিব হায় তবু যেতে দিতে হয়’। এশার আজানের পর সবার কাছ থেকে আমরা বিদায় নিয়ে চৌগ্রাম বাসস্ট্যান্ড পার হই। তারপর সিংড়া বাসস্ট্যান্ডে এসে যাত্রাবিরতি।

রাস্তার পাশে বেশকিছু ফাস্টফুড আইটেম বিক্রি করছে কয়েকজন উঠতি বয়সী তরুণ। গরম গরম পরোটা, ডিম, আলু ভাজি। প্রথমে খাব কি খাব না ভাবতে ভাবতে শুরু করা হলো।

বেশ ভালো লাগল গরম পরোটা। নাস্তাপর্ব শেষ করে আবার যাত্রা শুরু। অবশেষে বনপাড়া। নির্ধারিত সময়ের আগে পৌঁছে গেলাম বাসায়।

আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে দয়ারামপুরের উদ্দেশ্যে উজ্জ্বল ও তার টিম রওনা হয়ে গেল নতুন কোনো গন্তব্যের পরিকল্পনা নিয়ে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!