সন্তানদের বড় করা, তাদের লালন-পালন (পেরেন্টিং) সত্যিই একটি কঠিন কাজ। এতে শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই অনেক পরিশ্রম করতে হয়। এই ডিজিটাল যুগে যেখানে শিশুরা খুব সহজেই বিভিন্ন ধরণের তথ্যের সংস্পর্শে আসে, সেখানে তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত এবং উদ্বেগজনক বিষয়ের একটি হলো শিশু-কিশোরদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি। প্রযুক্তি যেমন আমাদের জীবনকে সহজ করে তুলেছে, তেমনি এর অপব্যবহার বা অতি ব্যবহার হয়ে উঠেছে নতুন প্রজন্মের জন্য এক গভীর সমস্যা। বিশেষ করে ছোট বয়সেই যদি শিশুরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াতে সময় কাটাতে থাকে, তাহলে তা তাদের মানসিক, সামাজিক এমনকি শারীরিক বিকাশেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
কখন থেকে শিশুদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত?
বিশেষজ্ঞরা সাধারণত মনে করেন ১৩ বছরের নিচের শিশুদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার একেবারেই নিরুৎসাহিত করা উচিত। কারণ এই বয়সে তাদের মানসিক ও আবেগগত পরিপক্বতা যথেষ্ট হয় না। যদিও অনেক শিশুই বয়স বাড়িয়ে ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলে।
তবে যদি আপনি মনে করেন যে আপনার সন্তানের ডিজিটাল উপস্থিতি প্রয়োজন, তাহলে তাকে খুব সীমিতভাবে এবং তত্ত্বাবধানের আওতায় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে দিন।
১. ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট
কে কি বলছে তার সবটা সত্যি নয়, তবে বাচ্চারা সহজেই সব কিছু বিশ্বাস করে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্বাস করলে তার মাশুল দিতে হতে পারে কয়েকগুণ। নিজের পরিচয়, বাসস্থান বা অন্য কোনো বিষয়ে ও অন্য মানুষটি যা বলছে, তা সবসময় বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। অত্যন্ত সুন্দর আচরণের পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে খারাপ কোনো উদ্দেশ্য। তাই কারও সঙ্গে কথা বললে সতর্ক থাকতে হবে। কারও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করলেও ভেবে চিন্তা করে করতে হবে।
২. সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট
আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করা একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবন, ভ্রমণ, বা বিশেষ মুহূর্তের ছবি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করে থাকে। এ সব পোস্ট, পোস্টে কমেন্ট, লাইক বা শেয়ার করবে তা থেকে যাবে আজীবন। আজ যা ঠিক মনে হচ্ছে, আগামীকাল তার জন্য অনুশোচনা হতেই পারে। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু করার আগে হাজারবার ভাবতে হবে।
৩. সাইবার বুলিং
সাইবার বুলিং হল ডিজিটাল ডিভাইস (যেমন মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ট্যাবলেট) ব্যবহার করে কাউকে হয়রানি করা বা উত্ত্যক্ত করা। এটি সাধারণত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেক্সট মেসেজ বা ইমেলের মাধ্যমে ঘটে থাকে। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হলে মানসিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।
৪. শিশুরা নিরাপত্তাহীন
অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের বন্ধু হয়ে ওঠার। তাদের বোঝানো দরকার কী হয়েছে তা বড় বিষয় নয়। কোথাও সমস্যা হলে বা নিরাপত্তাহীন মনে হলেই অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলা আবশ্যক। অভিভাবকরা কিছু কি বলবেন এটা ভেবে দূরে সরে না থেকে সমস্যাগুলো খোলাখুলি বলতে হবে।
৫. ব্যক্তিগত তথ্য লেনদেন
ছোটদের শিখাতে হবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত তথ্য লেনদেন করা ভালো নয়। এতে করে নিজের বা পরিবারের ক্ষতি হতে পারে। পুরো নাম, ঠিকানা, স্কুলের তথ্য বা বাবা-মায়ের তথ্য, কিছু যেন ভুলেও সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার না করে ছোটদের সেটা বুঝাতে হবে।
প্রযুক্তিকে শত্রু না বানিয়ে বন্ধু বানান
প্রযুক্তি থেকে শিশুদের পুরোপুরি দূরে রাখার চেষ্টা অর্থহীন। বরং শেখাতে হবে কীভাবে প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হয়। আপনি নিজেই যদি সন্তানের সঙ্গে বসে তার পছন্দের ভিডিও দেখেন বা একসঙ্গে টিউটোরিয়াল ভিডিও দেখেন, তাহলে সেটা শিক্ষামূলক হতে পারে।
যদি সন্তান বিপথে চলে যায়?
- ধৈর্য ধরুন, একবারে কঠোর হবেন না।
- তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করুন।
- প্রয়োজনে কাউন্সেলরের সাহায্য নিন।
- পরিবারে একসঙ্গে সময় কাটান আলাদা করে সময় দিন।
আমরা এমন এক যুগে বসবাস করছি যেখানে প্রযুক্তি আর বাস্তবতা একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একদিকে যেমন প্রযুক্তির সুযোগ, অন্যদিকে আছে ফাঁদ। আপনার শিশুকে ফাঁদে পড়তে দেবেন না, বরং তাকে শেখান কীভাবে সঠিকভাবে পথ চলতে হয়।
সোশ্যাল মিডিয়া ভালো-মন্দ দুইয়ের মিশ্রণ। আপনি যদি সন্তানকে সঠিকভাবে গাইড করতে পারেন, তাহলে এটি তার জন্য একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম হতে পারে শেখা, যোগাযোগ এবং আত্মপ্রকাশের জন্য। তাই দায়িত্বশীল অভিভাবক হিসেবে আপনার ভূমিকা, সচেতনতা ও সময় দেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।