করোনা প্রাদুর্ভাবের পর বিশ্বজুড়ে ভ্রমণকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে পর্যটন খাতে ভ্রমণপিপাসুদের আগ্রহ বেড়েই চলছে। তবে বাংলাদেশ থেকে অনেক দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া জটিল হওয়ার কারণে অনেকেই এ জন্য বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীর শরণাপন্ন হতে চান। কিছু ক্ষেত্রে ভ্রমণকারী নিজেও এই ঝক্কি না পোহাতে এবং ত্রুটিপূর্ণ ভিসা আবেদনের ঝুঁকি এড়াতে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির সেবা গ্রহণ করেন। আর ট্রাভেল এজেন্সিগুলোয় কাজটি করে থাকেন ‘ভিসা প্রসেসিং অ্যানালিস্ট’রা। ফলে দাপ্তরিক এবং ফ্রিল্যান্সার হিসেবেও সফল ক্যারিয়ার সম্ভব সম্ভাবনাময় এ পেশায়। ‘ভিসা প্রসেসিং অ্যানালিস্ট’ পেশার খুটিনাটি বিষয় সোমবার (১৮ মে) জানাচ্ছেন উইংস ট্রাভেলসের ভিসা অ্যানালিস্ট হালিমা ইয়াসমিন মুক্তা। এ ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘ ৫ বছর সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলেছেন শাওন সোলায়মান।
‘ভিসা প্রসেসিং অ্যানালিস্ট বা এক্সপার্ট’ পেশাটা মূলত কী?
ভিসা প্রসেসিং অ্যানালিস্ট বা ভিসা এক্সপার্ট এমন একজন পেশাজীবী, যিনি কোনো ব্যক্তির পক্ষে একটি নির্দিষ্ট দেশের ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন করার দিকনির্দেশনা, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট ব্যবস্থাপনা এবং কৌশলগত পরামর্শ দেন। ভ্রমণকারীর প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে তার জন্য উপযুক্ত ভিসা ক্যাটাগরি নির্ধারণ, ডকুমেন্ট চেকলিস্ট তৈরি ও যাচাই, ভিসা আবেদন ফরম পূরণ যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ডিএস-১৬০, ইউরোপের শেনজেনভুক্ত দেশের ক্ষেত্রে শেনজেন ফরম, কভার লেটার বা স্পন্সরশিপ লেটার তৈরি, দূতাবাসে ইন্টারভিউ দিতে হলে তার জন্য ক্লায়েন্টকে প্রস্তুত করা এবং ভ্রমণসংক্রান্ত কোনো রাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন বিভাগ বা দূতাবাস থেকে জারি করা নীতিমালা ও সর্বশেষ আপডেট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থেকে ক্লায়েন্টকে সে অনুযায়ী পরামর্শ দেওয়াই ভিসা প্রসেসিং অ্যানালিস্টের মূল দায়িত্ব।
এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহীরা যে বিষয়ে পড়াশোনা করবেন
এ পেশায় আসতে নির্দিষ্ট একাডেমিক কোর্স না থাকলেও ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক বা জনপ্রশাসন বিষয়ে পড়াশোনা থাকলে সুবিধা পাওয়া যাবে। আর ইংরেজি ভাষার ওপর অবশ্যই দক্ষতা থাকতে হবে। বিদেশি রাষ্ট্র থেকে যেহেতু ভিসাসংক্রান্ত নীতিমালা ইংরেজিতে থাকে, আবেদন ফরম ইংরেজিতে পূরণ করতে হয়, তাই ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা একজন ভিসা প্রসেসিং অ্যানালিস্টকে এ পেশায় এগিয়ে রাখবে।
কর্মক্ষেত্রে এ পেশার চাহিদা কেমন? ক্যারিয়ার অপশন কী?
কর্মক্ষেত্রে এ পেশার চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, বিশেষত চারটি ক্ষেত্রে ট্রাভেল এজেন্সি বা ট্যুর অপারেটর, বিদেশে উচ্চশিক্ষা, ইমিগ্রেশন প্রতিষ্ঠান এবং কর্মীরা অধিক পরিমাণে বিদেশ সফর করেন এমন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন বা মানবসম্পদ বিভাগে। বর্তমানে অনলাইন ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রি (ওটিএ) খাত বড় হচ্ছে। শেয়ার ট্রিপ, গো জায়ানের মতো প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম বাড়াচ্ছে। কাজেই ওটিএতে ভিসা প্রসেসিং অ্যানালিস্টের চাহিদা রয়েছে। এর বাইরেও একজন দক্ষ অ্যানালিস্ট ফ্রিল্যান্সার হিসেবেও কাজ করতে পারেন। আর ক্যারিয়ার বিকাশেরও দারুণ সুযোগ রয়েছে এ খাতে। জুনিয়র পজিশন থেকে ক্যারিয়ার শুরু করে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোতে ‘হাইলেভেল’ পর্যায়ে যেমন ভিসা টিমের প্রধান বা শাখা প্রধান হওয়ার পাশাপাশি নিজেও উদ্যোক্তা হয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ক্যারিয়ারের শুরুতে কেমন বেতন পাওয়া যায়?
বাংলাদেশে এ পেশায় নতুনরা সাধারণত ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। তবে পরবর্তী সময়ে অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা অনুযায়ী বেতন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিদেশি গ্রাহক থাকলে বা নিজস্ব ফার্ম থাকলে আরও বেশি আয় করা সম্ভব।
একজন পর্যটক নিজেও তো তার ভিসা প্রসেস করতে পারেন। তাহলে এক্সপার্ট কেন দরকার?
হ্যাঁ, কেউ চাইলে নিজেই আবেদন করতে পারেন। তবে সেখানে কিছু জটিলতা থাকে। যেমনঃ সঠিক ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়া না জানা, ভুল তথ্য পূরণ, ভুল ভিসা ক্যাটাগরিতে আবেদন, দূতাবাসের চাহিদা বুঝতে না পারা এবং নিজের কর্মব্যস্ততার মধ্যে সময় করতে না পারা। এসব জটিলতা এড়াতেই প্রয়োজন হয় একজন অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীর। তবে কেউ যদি নিজের ভিসা আবেদন নিজেই সফলভাবে করতে পারবেন বলে মনে করেন, তাহলে সেটা তিনি করতেই পারেন। ভিসা অ্যানালিস্টদের কাছে যেতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
ভিসা প্রসেসিং ট্যুরিজমে কীভাবে অবদান রাখে?
একজন ভিসা এক্সপার্ট, ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য ভিসা প্রাপ্তি সহজ করেন। ভিসার পাশাপাশি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে ট্যুরিজম এজেন্সির প্যাকেজ সেবাও দেওয়া যায়। গ্রুপ ট্যুরের ভিসা প্রক্রিয়ার কাজ করা যায়। বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভ্রমণকারীর সর্বপ্রথম এবং অত্যাবশকীয় বিষয় হচ্ছে ভিসা। একজন ভিসা অ্যানালিস্ট তাই পর্যটকের কাছে ভ্রমণসংক্রান্ত প্রচার করেন। ফলে তিনিই এ খাতের ‘ফার্স্ট অ্যাম্বাসাডর’ এ পরিণত হন। এভাবে তিনি এটি সরাসরি দেশের আন্তর্জাতিক পর্যটন রাজস্ব বৃদ্ধিতে অবদান রাখেন।
ভিসা অ্যানালিস্ট কি ভিসার গ্যারান্টি দেয়? কেউ যদি এমনটা দাবি করে তাহলে সেটা কি যথার্থ?
না, কোনো ভিসা অ্যানালিস্ট বা এজেন্সি কখনো ভিসার গ্যারান্টি দিতে পারে না। ভিসা দেওয়ার একমাত্র ক্ষমতা কনস্যুলার অফিসারের। যদি কেউ ‘১০০% গ্যারান্টি’ বা ‘ভিসা নিশ্চিত’ বলে, সেটি প্রতার বা অতিরঞ্জিত হতে পারে। এ ধরনের প্রতারণা থেকে পর্যটকদের সচেতন এবং সাবধান থাকতে হবে। অনেক সময় ‘নো ভিসা, নো ফি’ প্রচারও শোনা যায়। সেটাও প্রতারণা।
এ পেশার মূল চ্যালেঞ্জ কী এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপায় কী?
দূতাবাসগুলোর নিয়ম প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। তাই এ বিষয়ে একজন দক্ষ অ্যানালিস্টকে সবসময় আপডেট থাকতে হয়। দূতাবাসগুলোর ওয়েবসাইট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত নজর রাখতে হয়। কাজেই এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ার কাজ করতে গিয়ে গ্রাহকের অনেক ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল তথ্য অ্যানালিস্টের কাছে আসতে পারে, যা ভিন্ন কারো কাছে গ্রাহকের জন্য বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। তাই গ্রাহকদের উপাত্ত ব্যবস্থাপনা এবং গোপনীয়তা রক্ষা এ পেশায় আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভিসা অ্যানালিস্টদের এ ক্ষেত্রে পূর্ণ পেশাদারিত্ব এবং ‘এথিক্স’ মানতে হবে। পাশাপাশি গ্রাহকদের ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান হলে, তাদের দিক থেকে অ্যানালিস্টদের প্রতি একটা মানসিক চাপ থাকে। সেটা ‘হ্যান্ডেল’ করার দক্ষতা ও মানসিকতা থাকতে হবে। পর্যটন মৌসুমে মানুষ বেশি ভ্রমণ করে, তাই সে সময় বাড়তি চাপ নেওয়ার প্রস্তুতি থাকতে হবে। আর সবশেষে, অনেক গ্রাহক মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভিসার আবেদন করতে চায়। এ বিষয়ে কৌশলী হতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :