আর মাত্র এক সপ্তাহ পরেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। এই উৎসবকে ঘিরে সারা দেশে বইছে সাজ সাজ রব। পূজাকে কেন্দ্র করে কেউ নতুন পোশাক কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত, কেউ প্রতিমা তৈরি নিয়ে ব্যস্ত, আবার কেউ পূজামণ্ডপ তৈরিসহ আলোকসজ্জা ও আনুষঙ্গিক আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত।
এই উৎসবকে ঘিরে প্রতিমা তৈরিতে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পীরাও। অভিজ্ঞ হাতের জাদুতে সূক্ষ্মভাবে গড়ে তুলছেন দেব-দেবীকে। দেবী দুর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী-সরস্বতীসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিমা তৈরি করছেন তারা। মন্দিরে মন্দিরে পুরোদস্তুর চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ।
কেউ কেউ প্রতিমা তৈরির প্রাথমিক উপকরণ এক করে খড়কুটোর মাপকাঠি করছেন, আবার কেউবা প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আবার যেখানে পূজামণ্ডপ তৈরি হবে, সেখানে আলোকসজ্জা ও সাজসজ্জার কাজ চলছে পুরোদমে। পূজাকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজনও চলছে পুরোদমে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা হাজার হাজার মানুষ যেন মেলার আনন্দকে উপভোগ করতে পারে তার প্রস্তুতিতে সবাই ব্যস্ত।
সরেজমিন রাজধানীর রমনা কালীমন্দিরে দেখা যায়, প্রতিমার অবকাঠামো তৈরি প্রায় হয়ে গেছে। আর ২-৩ দিন পরেই শুরু হবে রঙ করার কাজ। সেখানকার একজন শিল্পী রতন পাল বলেন, ‘প্রতিমা তৈরির যাবতীয় কাজ প্রায় শেষের দিকে। এরপর রঙের কাজ শুরু হবে। তারপর প্যান্ডেলের সাজসজ্জা করব।’
রমনা কালীমন্দিরের দায়িত্বশীলরা জানায়, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কালীমন্দির প্রাঙ্গণে তিন দিনব্যাপী মেলা বর্তমানে চলমান। এখন আপাতত পূজাকে কেন্দ্র করে মেলার পরিবেশ জমজমাট। আগামী ২১ তারিখে এই মেলা শেষ হবে। তারপরেই মন্দিরের চারপাশে লাইটিং এবং সাজসজ্জার কাজ শুরু হবে।
পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজারে পূর্ব মোড়ে অবস্থিত শ্রী শ্রী শনিদেবের মন্দিরে চলছে সাজসজ্জার কাজ। সোনালি রঙে নতুন করে সাজছে এই মন্দিরটি।
সাজসজ্জার দায়িত্বে থাকা সবুজ মিয়া বলেন, ‘তিন দিন ধরে এই মন্দিরের সাজসজ্জার কাজ করছি। আরও দুদিন লাগবে কাজ শেষ করতে। ইতোমধ্যে আমাদের অন্য যারা মণ্ডপ তৈরির দায়িত্বে আছে তারা বাঁশ দিয়ে পাশেই স্টেজ তৈরি করছেন। বাকি কাজ প্রতিমা এলে করা হবে।’
পুরান ঢাকার শ্রী শ্রী রক্ষা কালীমাতা মন্দিরের আশপাশে চলছে দুর্গাপূজার সার্বিক প্রস্তুতির কাজ। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ২০-২৫ জন শ্রমিক পূজা মণ্ডপ তৈরির কাজ করছেন। গত কয়েকদিন ধরেই তারা এই কাজ করছেন। কেউ বাঁশ কাটছে, কেউ রশি দিয়ে বাঁশ বাঁধছেন আবার কেউবা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন। ২৮ তারিখের আগেই সব কাজ শেষ করার লক্ষ্যে দিনরাত পরিশ্রম করছেন তারা।
পুরান ঢাকার নর্থব্রুক হল রোডের শ্রী শ্রী প্রাণ বল্লভ জিঁউ মন্দির, শাঁখারিবাজার ও সূত্রাপুরের বিভিন্ন স্থানে মৃৎশিল্পীরা প্রতিদিন ১৪-১৫ ঘণ্টা করে কাজ করছেন।
প্রতিমা শিল্পীরা বলছেন, আগের চেয়ে কাজ বেড়েছে, আবার খরচও বেড়েছে। তবে সেই তুলনায় বাড়েনি পারিশ্রমিক। প্রতিমা তৈরির উপকরণের দামও চড়া। উপকরণ হিসেবে এঁটেল মাটি, খড়, বাঁশ, কাঠ, সুতলি ইত্যাদি সংগ্রহ করতে গত বছরের চেয়ে এবার বেশি দাম গুনতে হচ্ছে তাদের।
পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকার ১৬ নম্বর কে. জি গুপ্ত লেনে প্রতিমা তৈরি করছিলেন কিশোর সাহা (৫৬) নামে একজন মৃৎশিল্প। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রতিমা তৈরির সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে প্রতিমা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে আছি। জীবন-যৌবন সব এর মধ্যেই কেটেছে। বাবা আর বড় ভাইয়ের কাছ থেকে দেবী দুর্গা, গণেশ, কার্তিক সবাইকে তৈরি করা রপ্ত করেছি।
কিশোর সাহা বলেন, শুরুতে জীবিকার তাগিদে প্রতিমা তৈরি করলেও পরে ভালোবাসা আর ভালো লাগা থেকেই এ পেশায় থেকে যাওয়া। পুজোর সময় হলেই প্রতিমা তৈরির ব্যস্ততা বাড়ে। বাকি সময় প্রতিমা-শিল্পীদের তেমন কদর থাকে না।
প্রতিমা তৈরিতে কেমন খরচ হচ্ছে এবং আগের তুলনায় পারিশ্রমিক বেড়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে রাখাল পাল নামে আরেকজন মৃৎশিল্প বলেন, প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেড়েছে। প্রতিমা তৈরিতে ব্যবহৃত এক বস্তা মাটির (৫০ কেজির) দাম দুই-আড়াই হাজার টাকা। আছে পরিবহন খরচ। আগে যে খড়ের গাদা ৪০০ টাকা ছিল, এখন তার দাম ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। ১৫০ টাকার সুতলির বান্ডেল ২০০-২২০ টাকা, ২০০ টাকার বাঁশ এখন পাঁচশ টাকা। তবে সবকিছুর দাম বাড়লেও আমাদের পারিশ্রমিক কিন্তু বাড়েনি।
উল্লেখ্য, আগামী ২১ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে শারদীয় দুর্গোৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়বে। ২৮ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠী, ২৯ সেপ্টেম্বর সপ্তমী, ৩০ সেপ্টেম্বর অষ্টমী, ১ অক্টোবর নবমী, ২ অক্টোবর বিজয় দশমীর মধ্য দিয়ে ৫ দিনব্যাপী এই দুর্গোৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটবে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর এক হাজারের বেশি পূজামণ্ডপ বেড়েছে। গত বছর সারা দেশে ৩১,৪৬১ মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ২৫২টি মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার সেই সংখ্যা কিছুটা বাড়বে। সারা দেশে পূজামণ্ডপ প্রস্তুতের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন