সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৫, ০৫:৪২ পিএম

মতামত

রাজনীতিতে শিষ্টাচার-শুদ্ধাচারের আবশ্যকতা

মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৫, ০৫:৪২ পিএম

মোস্তফা কামাল। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

মোস্তফা কামাল। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

পক্ষ-বিপক্ষ, ভিন্নমত-মতবিরোধ এমন কি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা রাজনীতির উপাদানের মতো। এগুলো রাজনীতি ও রাজনীতিকদের বৈশিষ্ট্যও। পরনিন্দা চর্চাও চলে। কিন্তু, পারস্পরিক অশ্রদ্ধা ও ভাষার দুরবস্থা কখনোই সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ পছন্দ করে না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাবার্তায় খিঁচুনি-ভ্যাঙচি, খোঁচা, সর্বোপরি গালমন্দে মানুষ কতো বিরক্ত ছিল এর একটা ছাপ চব্বিশের ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার ক্রিয়াকর্মেও দেখা গেছে। পতন বা ক্ষমতাচ্যুত হলেও কাউকে নিয়ে এ ধরনের ট্রল-ব্যঙ্গ হতে পারে, তা বিরল ঘটনা। অনেকে বলে থাকেন- মুখদোষে, ভাষার যাচ্ছেতাই ব্যবহারবেশি ডুবিয়েছে তাকে।

টানা ক্ষমতাকালে শেখ হাসিনা নিজে তা হয় তো উপলব্ধির দরকার মনে করেননি। হিতাকাঙ্খীদের কেউ তাকে কখনো তা জানিয়েছেন বা সতর্ক করেছেন বলেও তথ্য নেই। খেলা হবে, খেলা হবে; তলে তলে ঠিক হয়ে গেছে –এ ধরনের ভাঁড়ামিতে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ওবায়দুল কাদের বা হাছান মাহমুদরাও ভাষাদোষে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সর্বনাশ কম করেননি। কথায় কথায় প্রতিপক্ষকে নিম্নমানের শব্দ-বাক্যে তাচ্ছিল্য করে কাদের, হাছান, ইনু, হানিফরা নিজেরা একটা পর্যায়ে স্রেফ ক্লাউনে পরিণত হয়েছেন।

শিষ্টাচারহীনতা, ভাষাগত বিকারগ্রস্ততার করুণ পরিণতি তো মাত্র বছরখানেক আগের ঘটনা। সেখান থেকে শিক্ষা নেয়ার নমুনা নেই। বরং গজবের মতো এর যেন নতুন চাষাবাদ। তাও আবার এক সময়ের সেই মার্জিত-সাহসীদের মুখে-আচরনেও। স্কুল শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্র মেরামত আন্দোলনের স্লোগান কী মার্জিত-রুচিসম্মত- সৃজনশীলই না ছিল । ‘যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাড়াও, তবে তুমিই বাংলাদেশ’। যা মানুষের চিন্তা জগতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় রক্তাক্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শ্লোগানও ছিল বুদ্ধিদীপ্ত। ‘বুকের ভেতর দারুন ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’‘চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে, হয়ে গেলাম রাজাকার’। ‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে’‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’। ‘বন্দুকের নলের সাথে ঝাঁজালো বুকের সংলাপ হয় না’।

মস্তিষ্কে ঝড় তুলে দেওয়া এসব শ্লোগানের পর এখন অশ্লীলতা-রুচিহীনতার পথে হাঁটছে। এ ধরনের মনকাড়া স্লোগান ও বক্তব্যের এ প্রজন্মই এখন কীসব শব্দবোমা ছুঁড়ছে? মুখ দিয়ে যা আসছে বলছেন। মুখের ভাষার সাথে শরীরের ভাষায়ও দুর্গন্ধ। মুখের মূল কাজ কথা বলা ও খাওয়া। তবে, মোটেই যা ইচ্ছা তা বলা মুখের কাজ নয়। যা ইচ্ছা তা খাওয়াও নয়। রাজনীতিতে রুচিহীনতা বা অশ্লীলতা দিয়ে সস্তা দরে মাঠ কাঁপানো যায়। কিন্তু, মানুষ তা কোনোকালেই গ্রহণ করেনি। ক্ষণিক সময়ের জন্য নোঙরামিতে হাইপ তুলে ভাইরাল হওয়া এক জিনিষ, আর প্রসিদ্ধি পাওয়া আরেক জিনিষ। দিনশেষে রাজনীতিতে শিষ্টাচার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার। নেতার মধ্যে শিষ্টাচার থাকলে তার কর্মীরাও সভ্য হয়। দলীয় ক্ষমতার মোহে কাউকে গালিগালাজ করলেই বড় হওয়া যায় না। বড় জোর কয়েকদিন আলোচিত হওয়া যায়। প্রতিবাদ অসভ্য ভাষায় কার্যকর হয় না। এতে মর্যাদা-সম্মান আগে নিজেরটা নষ্ট হয়। আর নিজের বা কারো সম্মানবোধ না থাকলে তো কথাই নেই।

হালে নতুন উদ্যমে ভিন্নমতকে গালিগালাজের যে বিকৃত-ধিকৃত চর্চা শুরু হয়েছে, তার বেশিরভাগই উচ্চারণের, লেখার অযোগ্য। অকথ্য এসব শব্দ নূন্যতম সুস্থ সমাজেও বেমানান। চরম অসভ্যতাও। গালিগালাজকে রাজনীতির এ স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে আসা আগামীর জন্য খুব অশনি সংকেত। কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ অসামাজিকতায় কেবল শরীক নয়, মদদও দিচ্ছে। এ প্লাটফর্মগুলো এখন বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। কাউকে অপদস্থ করার উপযুক্ত মাধ্যমটির দিকে বেশ জোক কারো কারো। সম্মিলিতভাবে তারা দেশকে গালমন্দ ও ঘৃণা চাষের উর্বর ভূমি করে তুলছে। তা করতে গিয়ে সুস্থ আলোচনা, শালীন বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি যুক্তির চেয়ে এখন বিতর্কিত কোনো একটি তকমা লাগানো, অশালীন ভাষার আমদানি, অর্ধসত্য বা খন্ডিত তথ্যের প্রচার-প্রসার।  সেখানে যুক্তির চেয়ে গালিগালাজ, মতবিরোধের জায়গায় অপমান, আর ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধার বদলে বিদ্বেষ। সামগ্রিকভাবে তা একটি প্রজন্মকে নিয়ে যাচ্ছে রসাতলে। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যাচ্ছে তা আর জোয়ান-বুড়ার ফের মানছে না।

জুলাইবিপ্লবীদের হেদায়েত করতে গিয়ে সেদিন ঘটনা চক্রে দৃশ্যপটে আগমন এক সময়ের তুখোড় নেতা, সাবেক মন্ত্রী, প্রয়াত মানিকমিয়ার পুত্র আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর। ছেলেপেলেগুলোর ভাষা-আচরণ, স্লোগানে, বর্তমান সরকারের ভূমিকায় কী মাত্রায় অপমানিত বোধ করছেন, তা বলছিলেন তিনি। অবাক, বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, উপরোক্ত কথাগুলোর ফাঁকে তিনি নিজেও এমনসব শব্দ-বাক্য যোগ করেছেন, যা লেখা বা ছাপার অযোগ্য। প্রযুক্তির কল্যাণে স্যোশালমিডিয়ায় রিল হয়ে ঘুরছে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কথাগুলো। ওই সময় তাকে কেউ বারণ করেননি এসব শব্দ উচ্চারণ না করতে। বরং তৃপ্তি পেয়েছেন, হাত তালি দিয়েছেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত জোয়ান-বুড়ারা।

স্বাভাবিকভাবেই তা ক্রমশ সংক্রমিত হচ্ছে রাজনীতিতে, সমাজে। জুলাই আন্দোলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের সঙ্গে বিভিন্ন দলের নেতারা কথা বলেছেন, পরামর্শ নিয়েছেন। লন্ডন গিয়ে দেখাও করেছেন কেউ কেউ। সেখানে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সাথে দেখা করা একটি দলের নেতারাও এক পর্যায়ে তারেক রহমান ও বিএনপি সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন তা রাজনীতির বাইরের মানুষকেও আহত করেছে। যা চরমভাবে রাজনৈতিক শিষ্টাচার পরিপন্থি। এতো বড় একটি বিজয় তথা অভ্যত্থানের কিছুদিন না যেতেই  রাজনীতিতে প্রতিহিংসা, আক্রমণ, প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের অসহিষ্ণু প্রবনতার যে নতুন চাষাবাদ চলছে তা পারস্পরিক সন্মান ও শ্রদ্ধাবোধের বিলুপ্তি ঘটাবে কি-না, এ প্রশ্ন ঘুরছে।

কুৎসিত, বিকৃত কথামালা ও কাদা ছোড়াছুড়ির জের যে কতো বেদনার হয়, তা নতুন করে ভাবার বিষয় নয়। কেবল বছরখানেক আগের ঘটনা মনে করলেই হয়। নানা সমালোচনার পরও রাজনৈতিক নেতা ও কর্মিরাই সমাজকে পথ দেখান। ভালো –মন্দ যে পথ তারা দেখান দিনশেষে দেশ সেদিকেই যায়। তাই তাদের কাছ থেকে দেশের জনগণ শিখবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছুদিন ধরে তারা এই সুন্দর ময়দানেও যে পাঠপঠন দিতে শুরু করেছেন, তা উদ্বেগ জাগাচ্ছে। সজ্জন ও আদর্শবান রাজনীতিবিদদের অভাব এই পরিস্থিতিকে আরও রূঢ় করেছে এবং এটি কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও বিদ্যমান। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মানসিকতা এবং অসহিষ্ণুতা অব্যাহত থাকলে স্বাভাবিকভাবেই শিষ্টাচার কমে যাবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভদ্রতা ও নম্রতার চেয়ে পেশিশক্তি এবং দলীয় আধিপত্য বেশি গুরুত্ব পাবে। রাজনীতিকরা জনগণের শ্রদ্ধা হারাতে থাকবেন। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। রাজনীতি কেবল দল বা ক্ষমতার লড়াই নয়। এটি আচরণ, শিষ্টাচার এবং নৈতিকতার প্রতিফলন। রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে মানুষ মোটাদাগে সততা, সহনশীলতা ও দায়িত্বশীলতা আশা করে।

রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতির দুনিয়া যতোদিন থাকবে, ততোদিন মতের অমিল থাকবে, বিরোধ থাকবে, কিন্তু তা অশালীন-শিষ্টাচারবিরোধী পথে? মোটেই না। এ পথে প্রতিপক্ষকে বিনাশ করা যায় না। নিজের অমরত্বও আসে না। বরং ভেতরে-ভেতরে সমালোচিত হতে হয়। এক সময় ধিকৃত হয়ে বিতাড়নে পড়তে হয়। এর বিপরীতে শিষ্টাচারের জন্যই তাকে জনগণ শ্রদ্ধা ও সন্মান করে। আইডল-আইকন হিসেবে তারা অনুকরণীয় হন। নইলে পতন বা মৃত্যুর পরও সমালোচনা-ঘৃণা অনিবার্য।  সেই দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে অসংখ্য।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!