ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই, ২০২৫

মায়ের স্বপ্নে বারবার ফিরে আসেন জুলাই শহিদ জাফর 

সোহেল আকন, মঠবাড়িয়া (পিরোজপুর)
প্রকাশিত: জুলাই ৫, ২০২৫, ০৫:৩৯ এএম
জুলাই শহিদ আবু জাফরের কবরের পাশে মা সেতারা বেগম। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

দরজার পাশেই বসে আছেন বৃদ্ধ সেতারা বেগম। চোখে জল, কণ্ঠে আকুতি ‘আমার জাফর আসবে না?’ প্রায়ই স্বপ্নে দেখা যায় তাকে। যেন সে বাসা থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে আসছে, মাকে ডেকে বলছে, ‘মা, আমি এসেছি।’ কিন্তু ঘুম ভাঙলেই বাস্তবের কঠিন দেয়ালে মাথা ঠেকে যায় তার।

২০২৪ সালের ১৮ জুলাইয়ের সন্ধ্যা। রাজধানীর গোলাপবাগে চলছিল রাজনৈতিক উত্তেজনা ও আন্দোলন। ঠিক সেই সময়ে পুলিশের ছোড়া গুলিতে নিহত হন বাসচালক আবু জাফর। তার গলায় ও বুকে গুলি লেগেছিল। পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

জাফরের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার ছোট মাছুয়া গ্রামে। পরিবারের ছোট সন্তান ছিলেন তিনি। পৈতৃক বাড়ির একচিলতে জমিতে স্ত্রী ও তিন ছেলেকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি ছোট্ট সংসার। ছিলেন শ্যামলী পরিবহনের বাসচালক। সেই রোজগারেই চলত পুরো পরিবার।

তার মৃত্যু এখনো মানতে পারেন না মা সেতারা বেগম। ঘরের ভেতরেই বসে থাকেন, চোখ সজল। মাঝে মাঝে কান্না চেপে রাখতে না পেরে ফুঁপিয়ে ওঠেন। বলেন, ‘আমার ছেলের কী অপরাধ ছিল? কেন তাকে গুলি করে মেরে ফেলল? এখন আমরা নিঃস্ব।’

জাফরের বড় ছেলে পড়াশোনা শেষ করে বেকার। মেজো ছেলে কেরানীগঞ্জের একটি মাদ্রাসায় পড়ে। আর ছোট ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। বাবার মৃত্যু যেন এ পরিবারের ওপর নেমে আসা কালো মেঘ। সংসারের হাল ধরার কেউ নেই। মা বলেন, ‘আমার ছেলের রোজগারেই চলত সংসার। এখন এক মুঠো চাল জোগাড় করতেও কষ্ট হয়।’

পরিবারের সদস্যরা জানান, ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় মঠবাড়িয়া থেকে ঢাকায় রওনা দেন আবু জাফর। পরদিন বিকেলে পরিবহন কোম্পানি থেকে ফোন আসে, তাকে বাস কাউন্টারে যেতে বলা হয়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কর্মস্থলের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। 

এরপরই ঘটে ট্র্যাজেডি। পথে গুলিবিদ্ধ হন, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সড়কের ওপর। একজন পথচারী নারীর ফোনে পাওয়া খবরেই পরিবার জেনেছিল জাফরের মৃত্যুর কথা। সেই ফোনকল এখনো গুঞ্জরিত হয় পরিবারের সবার কানে।

উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে জানানো হয়েছে, জাফরের পরিবারকে প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. শফিকুল আলম বলেন, ‘পরিবারটিকে সরকারের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। তারা যেন টিকে থাকতে পারে, সে জন্য আমরা পাশে থাকার চেষ্টা করছি।’

সেতারা বেগম এখনো দরজার পাশেই বসে থাকেন। হয়তো তিনি জানেন, তার জাফর আর ফিরবে না। তবুও বুকের গভীরে কোথাও আশা জমে আছে। ‘কখনো তো বলিনি ওকে শেষবারের মতো চলে যেতে। একবার শুধু এসে বলুক ‘মা, আমি এসেছি’।’