অবরুদ্ধ গাজায় প্রায় তিন মাস অবরোধের পর সীমিত পরিসরে ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি দিয়েছে ইসরায়েল। এতদিন জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো কিছুই প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি ইসরায়েলি বর্বর হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এই উপত্যকায়।
জাতিসংঘসহ বিশ্ব যখন গাজায় তীব্র খাদ্য সংকটের কথা বলেছে, দখলদার ইসরায়েল তখন তা বরাবরই অস্বীকার করে গেছে।
অবরোধের প্রথম দিকে গাজার মানুষ টিনজাত শাক-সবজি, ভাত, পাস্তা ও মশুর ডাল খেয়ে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে রুটিও ফুরিয়ে গেছে। আছে শুধু আটা, সেগুলোও মেয়াদোত্তীর্ণ।
তীব্র ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে বহু আগেই। তাই এখন কোনোরকমে জীবন বাঁচাতে গাজার বাসিন্দারা পশুখাদ্য, বালিমিশ্রিত আটা খেতে শুরু করেছেন।
অন্যদিকে, শিশুরা ডায়রিয়া ও ক্ষুধাজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন। মার্চের শুরু থেকে কমপক্ষে ৫৭ জন শিশু অপুষ্টিতে মারা গেছেন বলে জানা গেছে। আর ইসরায়েলি অবরোধ অব্যাহত থাকলে আগামী ১১ মাসে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৭১ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগবে বলে আশঙ্কা।
চলমান যুদ্ধ ও অবরোধের কারণে গাজার ৯৩ শতাংশেরও বেশি শিশু (প্রায় ৯ লাখ ৩০ হাজার) দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে।
ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিইএ জানিয়েছে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হামলায় গাজার ৯২ শতাংশেরও বেশি বাড়ি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা বারবার বলেছে, ‘গাজায় পূর্ণ দুর্ভিক্ষ চলছে’।
মঙ্গলবার (২০ মে) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবরুদ্ধ গাজায় আজ প্রায় ১০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। গতকাল নয়টি ট্রাক প্রবেশের অনুমতি ছিল। জাতিসংঘের মানবিক কার্যালয়ের মুখপাত্র জেন্স লায়ার্কে জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘এসব ট্রাকে শিশুখাদ্য ও শিশুদের জন্য পুষ্টিকর পণ্য রয়েছে। পরবর্তী পদক্ষেপ হলো সেগুলো সংগ্রহ করা এবং বিদ্যমান ব্যবস্থার মাধ্যমে বিতরণ করা।’
তবে গাজায় আল-জাজিরার সাংবাদিক জানিয়েছে, ‘আমরা জানতে পেরেছি যে, ইসরায়েল গাজায় ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দিলেও কিছুই স্থানান্তর করা হয়নি। বর্তমান সংকট নিরসনের জন্য গাজায় প্রতিদিন প্রায় ৫০০টি মানবিক সহায়তা ট্রাক ও ৫০টি জ্বালানি ট্রাক প্রবেশের প্রয়োজন।’
সপ্তাহজুড়ে অভুক্ত গাজার নারী-শিশুরা
আল-জাজিরাকে ফিলিস্তিনি বাসিন্দা ইনগ্রাম বলেন, ‘মুষ্টিমেয় ত্রাণবাহী ট্রাক যথেষ্ট নয়। আমাদের দুই মিলিয়ন মানুষ তিন মাস ধরে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত মৌলিক সুবিধা (খাদ্য, পানি, ওষুধ) থেকে বঞ্চিত। এমনকি সামান্য পরিমাণে সাহায্য পৌঁছানোও শাস্তিমূলক। কারণ ইসরায়েলের বিতরণ পরিকল্পনা দক্ষিণ গাজার ‘মুষ্টিমেয়’ কেন্দ্রগুলোর উপর নির্ভর করে বলে মনে হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানুষকে ত্রাণ সংগ্রহ করার জন্য অনেক দূর হেঁটে যেতে হবে। প্রায় ২০-২৫ কেজির ওজনের প্যাকেট নিয়ে আবার হেঁটে ফিরে আসতে হবে। কল্পনা করুন যে কেউ ক্লান্ত, অসুস্থ, অপুষ্টিতে ভুগছে, অঙ্গচ্ছেদের হয়েছে- সেই মানুষরা কীভাবে এই সাহায্য পাবে? এটি মানবিক নীতি মেনে চলে না।’
ফরাসি চিকিৎসা সহায়তা গোষ্ঠী ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্সের জরুরি সমন্বয়কারী ক্লেয়ার মানেরা বলেছেন, ‘গাজার পরিস্থিতি ‘কখনো এমন দেখিনি’, যেখানে মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে এবং বাস্তুচ্যুত হয়ে ক্লিনিকগুলোতে ভিড় জমাচ্ছে। ইসরায়েলের প্রায় তিন মাসের সাহায্য অবরোধে নারী ও শিশুরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ থেকে আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমি এমন নারী ও শিশুদের দেখতে পাচ্ছি, দেখে মনে হচ্ছে তারা সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে কিছু খায়নি। আমরা জানি যে তারা রাতে ঘুমানোর জন্য নিরাপদ জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না খোলা হাসপাতাল সেবা ক্রমশ কমছে, কারণ সেগুলো হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।’
গতকাল প্রবেশের জন্য অনুমোদিত নয়টি ট্রাকের প্রথম ব্যাচ থেকে তার দল এখনো কোনো সাহায্য দেখতে পায়নি।
মানেরা আরও বলেন, ‘এখানে প্রয়োজনের তুলনায় নয়টি ট্রাক কিছুই নয়। আমাদের নিজস্ব সাহায্যের অনুমতি প্রয়োজন এবং আমাদের নিরপেক্ষভাবে এটি জনগণের জন্য ব্যবহার করতে সক্ষম হওয়া দরকার।’