জাতিসংঘের তদন্তকারীরা দক্ষিণ সুদানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন যে, বিশ্বের অন্যতম কনিষ্ঠ ও দরিদ্র এই দেশের কোটি কোটি ডলারের সম্পদ লুট করা হয়েছে। অথচ দেশের বেশিরভাগ অংশ এখন ক্রমবর্ধমান খাদ্য সংকটে ভুগছে।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বলেছে, ২০১১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে দক্ষিণ সুদানের কর্তৃপক্ষ সরকারি রাজস্ব থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ সরিয়ে নেওয়ার নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে।
রয়টার্স জানায়, কমিশন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, দেশটি ‘একটি লুণ্ঠনকারী অভিজাত শ্রেণির দখলে রয়েছে, যারা ব্যক্তিগত লাভের জন্য জাতীয় সম্পদের পদ্ধতিগত লুটপাটকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শক্তিশালী একটি ছোট গোষ্ঠী যখন জাতীয় সম্পদ লুট করে নিজেদের সমৃদ্ধ করছে, তখন রাষ্ট্র কার্যত জনগণের প্রতি দায়িত্ব পরিত্যাগ করেছে। খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এসব মৌলিক পরিষেবাও আন্তর্জাতিক দাতাদের ওপর নির্ভর করছে।’
১০১ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়কে ‘মহা দুর্নীতির’ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারের তেল-ফর-রোড কর্মসূচির আওতায় বিপুল পরিমাণ তেলের রাজস্ব বেনজামিন বল মেলের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলিতে সরানো হয়েছে। মেল প্রেসিডেন্ট সালভা কিরের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ছিলেন এবং চলতি বছর দ্বিতীয় সহ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
তদন্তে উঠে এসেছে, সড়ক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দকৃত ২.২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১.৭ বিলিয়ন ডলারের কোনো হিসাব নেই। অথচ উদ্যোগের ৯৫ শতাংশ রাস্তা এখনও অসম্পূর্ণ।
তবে দক্ষিণ সুদানের সরকার জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারের দাবি, প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হলো ‘দক্ষিণ সুদানের জনগণ ও নেতৃত্বের ভাবমূর্তি নষ্ট করা’।
একই সঙ্গে প্রতিবেদনে আরও একটি দুর্নীতির কৌশল চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ক্রফোর্ড ক্যাপিটাল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ভিসাসহ বিভিন্ন অনিয়মিত সরকারি ই-সেবা চালু করে লাখ লাখ ডলার আত্মসাৎ করা হয়েছে।
জাতিসংঘ কমিশনের মতে, দক্ষিণ সুদানে দুর্নীতির ওপর নজর দেওয়া জরুরি, কারণ এটি সরাসরি সরকারের মানবাধিকার অর্জনের ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ন করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ক্ষমতা, সম্পদ ও ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণের শূন্য-সমষ্টির প্রতিযোগিতায় আবদ্ধ দক্ষিণ সুদানের অভিজাতরা কেবল দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করছে। তারা জাতিগত পার্থক্য ও উত্তেজনা উসকে দিচ্ছে এবং তা কাজে লাগাচ্ছে।’
খাদ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ সুদানের ৭৯টি জেলার মধ্যে ৭৬টিই বর্তমানে তীব্র খাদ্য সংকটে রয়েছে। অথচ সংকট মোকাবিলায় সরকারের বরাদ্দ অত্যন্ত নগণ্য।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নতুন করে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা
এদিকে দেশটির বরখাস্ত হওয়া প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট রিক মাচারের বিরুদ্ধে হত্যা, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। বিচারমন্ত্রী গত সপ্তাহে ঘোষণা দেন, মার্চ মাসে ফেডারেল বাহিনীর ওপর একটি মিলিশিয়ার হামলায় মাচারের সম্পৃক্ততার অভিযোগের ভিত্তিতেই এ মামলা হয়েছে। ফলে দক্ষিণ সুদানে আবারও গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই প্রেসিডেন্ট সালভা কির ও মাচার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী।
২০১৩ সালে স্বাধীনতার দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। কির তখন মাচারকে অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে উপরাষ্ট্রপতি পদ থেকে বরখাস্ত করেন। এ সংঘাতে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪ লাখ মানুষ নিহত হয়। আর জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। পরে ২০১৮ সালে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে কির ও মাচার জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনে সম্মত হন।
তবে চলতি বছরের শুরু থেকেই সেই ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারির শেষদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় হাই নীল প্রদেশে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার পর কির সরকারের পক্ষ থেকে মাচারের দলের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে আটক করা হয়। এদের মধ্যে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর উপ-প্রধানও ছিলেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন