চারদিকে যখন বৃক্ষনিধনের উৎসব চলছে, তখন বৃক্ষরোপণকে ‘প্রতিবাদের ভাষা’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন শাহ সিকান্দার আহমদ শাকির। তিনি গত এক যুগ ধরে একাই রোপণ করেছেন ৩৪ হাজার ৮টি গাছ।
শাকির নিজে কোনো পরিবেশবাদী সংগঠনের ব্যানারে নেই, তাঁর পেছনে নেই কোনো করপোরেট স্পন্সর, নেই কোনো এনজিও’র বরাদ্দ। তবু প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন একক বৃক্ষরোপণ।
শুরু যেভাবে
সিলেট শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া শাকিরের পরিবেশ-সচেতনতা শুরু হয় শৈশবেই। বাড়ির পাশের একটা পুরোনো গাছ কেটে ফেলার পর তাঁর ভেতরে এক ধরনের না বলা বেদনা জন্ম নেয়। তখন তিনি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। সেই কষ্টকে আশীর্বাদে রূপান্তর করে নেয় তার শিশুমন। নিজের ঈদের সালামির টাকায় প্রথম চারা কেনেন। নিজে রোপণ করেন, পানি দেন, ভালোবাসেন। তখন থেকেই শুরু হয় এই একক অভিযাত্রা।
২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর—এক প্রিয়জনের জন্মদিনে রোপণ করেন ১৩টি চারা। দিনটি তাঁর জীবনে ‘স্মারক মুহূর্ত’ হয়ে ওঠে। এরপর থেকে প্রতিটি জন্মদিন, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ঈদ কিংবা বইমেলার মতো দিনে তিনি নিজ হাতে গাছ লাগিয়েছেন, নির্দিষ্ট সংখ্যা নির্ধারণ করে।
স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির, কবরস্থান থেকে শুরু করে সড়ক বিভাজন কিংবা সরকারি ফাঁকা জায়গা—শাকিরের গাছ পৌঁছে গেছে সিলেট শহরের প্রান্তে প্রান্তে। শুধু রোপণ নয়, তিনি নিজ হাতে এসব গাছের যত্নও নেন। কোথাও গাছ মরে গেলে নতুন করে চারা রোপণ করেন।
নিম, হরীতকী, বহেরা, নাগেশ্বর, দেবদারু, রাধাচূড়া, কদম, আম, জাম, কাঁঠাল, আমলকী, লটকান, কৃষ্ণচূড়া, কাঠগোলাপ, জলপাই, ডালিম, মাল্টা, ডালিয়া—শতাধিক প্রজাতির গাছের তালিকা তৈরি করেছেন তিনি। এমনকি কোনো গাছ রাতের আঁধারে কেউ তুলে নিয়ে গেলে দমে যাননি। বরং ফের গাছ রোপণ করেন একাগ্রতা ও ভালোবাসা নিয়ে।
ভালোবাসা আর প্রতিবাদের ভাষা বৃক্ষরোপণ
গাছ তাঁর কাছে শুধু প্রকৃতিই নয়, ভালোবাসা ও প্রতিবাদের প্রতীকও। চারদিকে যখন গাছের অযত্ন-অনাদর ও নিধন হচ্ছে, তখন তিনি বৃক্ষরোপণকে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে দেখছেন। এ ছাড়া ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও দেখছেন বৃক্ষরোপণকে। তাঁর মতে, গাছ অক্সিজেন দেয়, মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। সুতরং গাছের প্রতিও যত্নশীল হতে হবে। গাছকেও ভালোবাসতে হবে।
শাকির জানান, তিনি প্রিয়জনের জন্মদিনে গাছ লাগান, কাউকে উপহার দিতে গেলে চারা তুলে দেন হাতে। আবার যখন দেখেন নিজের লাগানো দেবদারু গাছ কেটে সিটি করপোরেশন অন্য গাছ লাগিয়েছে—সেই কষ্ট তাঁকে নতুনভাবে গাছ লাগাতে অনুপ্রাণিত করে। গাছ কাটার প্রতিবাদ তিনি গাছ লাগিয়েই করেন।
বেতনের একটি অংশ রাখেন গাছ কেনার জন্য
শাকিরের জীবনের গল্পও কম কষ্টের নয়। রাজমিস্ত্রি বাবার অসুস্থতা, সংসারের দায়িত্ব, টিউশনি করে লেখাপড়া—সবকিছুর ভেতরেও বৃক্ষরোপণ কখনো থেমে যায়নি। স্নাতকোত্তর করেছেন সিলেট এমসি কলেজের ইংরেজি বিভাগ থেকে। এখন কাজ করছেন সিলেটের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে হিসাব শাখায় কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে। আয়ের একটি অংশ এখনো রাখেন গাছের জন্য।
শাকির মনে করেন, মানুষকে যদি বই ও গাছপ্রেমী বানানো যায়, তাহলে সমাজ থেকে অপরাধ, নারী নির্যাতন এমনকি কুসংস্কারও অনেকটা দূর হবে। তাঁর ভাষায়, ‘গাছ লাগানো খাওয়ার চেয়েও সহজ। শুধু ভালোবাসা আর সচেতনতা দরকার।’
তাঁর লাগানো গাছগুলোর মধ্যে রয়েছে– নিম, হরীতকী, বহেরা, নাগেশ্বর, বকুল, দেবদারু, রঙ্গন, শিমুল, রাধাচূড়া, কড়ই, শীল, অর্জুন, চাকারশি, কাঠবাদাম, লুকলুকি, আগর, আম, জাম, জামরুল, গোলাপজাম, কাঁঠাল, তালবীজ, কামরাঙা, আমলকী, লটকান, তেঁতুল, আকাশি, জবা, শিউলি, চেরিফল, চেরিফুল, পেয়ারা, সফেদা, বাগানবিলাস, হাসনাহেনা, বেল ব্যাট, কৃষ্ণচূড়া, কদম, বকফুল, নারিকেল, জলপাই, কাঁঠালচাঁপা, কাঞ্চনমালা, কাঠগোলাপ, বেলি, টগর, দুরন্ত, পাতাবাহার, নয়নতারা, মাল্টা, কমলা, ডালিম, সজিনা, বড়ই, আপেল কুল, লিচু, অপরাজিতা, ডালিয়া, জাম্বুরা প্রভৃতি।
শাহ সিকান্দার আহমদ শাকির বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন অক্সিজেন নিই, প্রকৃতির ওপর নির্ভর করি, কিন্তু তার যত্ন নিই না। আমার লক্ষ্য শুধু গাছ লাগানো নয়, মানুষকে গাছের গুরুত্ব বোঝানো। প্রতিটি গাছ মানে নতুন জীবন। তাই আমি যত দিন বাঁচব, গাছ লাগিয়ে যাব।’