ঈদুল আজহার বাকি আর ছয় দিন। এ উপলক্ষে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ২১টি অস্থায়ী পশুর হাট বসবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেশির ভাগ হাটের ইজারা চূড়ান্ত হয়ে আছে। বিগত সরকারের আমলে নামে-বেনামে এসব হাটের ইজারা নিয়েছিলেন আওয়ামী নেতাকর্মীরা, কিন্তু এবার বিষয় ভিন্ন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের লোকজন পলাতক থাকায় তাদের কেউ হাট ইজারায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
এবার রাজধানীর অধিকাংশ পশুর হাট মিলেমিশে পেতে যাচ্ছেন বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মীরা। মূলত তাদের সুপারিশ ও পছন্দের ইজারাদারদেরই হাটের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) এক আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, এবার দক্ষিণ সিটিতে ৯টি পশুর হাট বসবে। এর মধ্যে একটি হাট জামায়াত, আরেকটি এনসিপি নেতাদের পছন্দের সুপারিশে ইজারাদার দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো পেয়েছেন বিএনপির পছন্দের ইজারাদারেরা।
এদিকে উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) এক আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা এবং কয়েকটি ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত আরেক (১০, ১১, ১২, ১৩) কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, উত্তর সিটিতে ১২টি অস্থায়ী পশুর হাট বসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এনসিপির সুপারিশে তিনটি হাট পেতে যাচ্ছেন তাদের পছন্দের ইজারাদারেরা। দুটি জামায়াতের পছন্দের এবং বাকিগুলো বিএনপি ও অন্যরা।
উত্তর ও দক্ষিণ সিটির সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে ঈদুল আজহার দিনসহ মোট পাঁচ দিন নির্ধারিত স্থানে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় করা হবে।
গত বছর গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির নেতাকর্মীরা পলাতক থাকায় এবার অধিকাংশ হাটই যাচ্ছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতাকর্মীদের হাতে। তবে ঈদের আর ছয় দিন বাকি থাকলেও এখনো অধিকাংশ হাটের ইজারাদার চূড়ান্তের শেষ পর্যায়ে। এরই মধ্যে তিনটি অবৈধ হাট বসেছে। আরও তিনটি অবৈধ হাট বসানোর প্রস্তুতি চলছে।
হাটগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ: এদিকে রাজধানীর পশুর হাটগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ে এবার ব্যাপক অভিযোগ করছেন ব্যাপারীরা। বেশির ভাগ পশুর হাটের ইজারাকাজ সম্পূর্ণ না হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। হাটের আনুষ্ঠানিকতা শুরু না হলেও ক্রেতারা হাটে আসছেন, তবে ব্যাপারীরা অতিরিক্ত দাম চাইছেন বলে অভিযোগ তাদের।
সরেজমিনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন পশুর হাটে কিছু বাঁশ ছাড়া তেমন কোনো ব্যবস্থাপনা দেখা যায়নি। ঝড়-বৃষ্টিতে পশু নিয়ে কষ্টে সময় পার করছেন ব্যাপারীরা। এমন পরিস্থিতিতে পড়ার কারণে ব্যাপারীরা ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
সূত্রমতে জানা যায়, ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দরদাতা জটিলতায় নিশ্চিত করতে পারেনি হাটের ইজারাদার। এরই মধ্যে মাঝেমধ্যে ক্রেতারা আসছেন, যাচাই করে যাচ্ছেন পশুর বাজারদর। তবে ঢাকার অধিকাংশ হাট ইজারাদাররা পশু রাখা ও কেনাবেচার উপযোগী করে তুলতে না পারায় পশু ব্যবসায়ী ও পশুর মালিকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
এদিকে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভে নগর ভবন তালাবদ্ধ থাকায় ইজারা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রশাসক শাহজাহান মিয়া চলমান প্রশাসনিক অচলাবস্থার কথা স্বীকার করে বলেন, কয়েক দিন ধরে আমরা কোনো সেবা দিতে পারছি না। এমনকি অনেক ইজারাদারের ফাইলও দেখা সম্ভব হয়নি। অবরোধের কারণে, আমরা পশুর হাটের ইজারা চূড়ান্ত করতে বা ওয়ার্ক অর্ডার দিতে পারছি না।
ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ মে করপোরেশন এলাকার আটটি পশুর হাটের প্রথম পর্যায়ের উন্মুক্ত ইজারা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে গত শনিবার যাচাইবাছাই শেষে খিলক্ষেত মস্তুল চেকপোস্ট-সংলগ্ন খালি জায়গায় সুরমি এন্টারপ্রাইজের নামে মজিবুল্লা খন্দকার হাটের ইজারা নিয়েছেন। তবে হাটটি পরিচালনা করছেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আকতার হোসাইন।
আর ঢাকা পলিটেকনিকের খেলার মাঠের হাটটি ডিএনসিসি প্রথমে সর্বোচ্চ দরদাতাকে বাদ দিয়ে ৭৭ লাখ টাকা কমে তৃতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা এসএফ করপোরেশনকে ইজারা দিতে কার্যাদেশ প্রস্তুত করলেও সমালোচনার মধ্যে হাটটির ইজারা পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। হাটটি এখন সর্বোচ্চ ২ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জায়ান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী যুবদল নেতা মনিরুজ্জামান পাচ্ছেন বলে ডিএনসিসি সূত্র জানিয়েছে।
গত বুধবার ডিএনসিসির এই ছয় হাটসহ মোট সাতটি হাটের ইজারার দর উন্মুক্ত হয়। মিরপুরের কালশী বালুর মাঠের খালি জায়গাসংলগ্ন হাটটিতে সরকারি মূল্যের চেয়ে ৫০ লাখ টাকা কমে ৩০ লাখ ২০ হাজার টাকায় সর্বোচ্চ দর দিয়েছেন ঢাকা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান।
তিনি বলেন, হাটের জায়গাটি অত্যন্ত কম। এর ফলে সরকারি মূল্যের চেয়ে কম হলেও সর্বোচ্চ দর আমি দিয়েছি। করপোরেশনের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। হাটটি পেতে আমি আশাবাদী।
ভাটুলিয়া সাহেব আলী মাদ্রাসা থেকে ১০ নম্বর সেক্টর রানাভোলা অ্যাভিনিউ-সংলগ্ন উত্তরা রানাভোলা স্লুইসগেট পর্যন্ত হাটটির সর্বোচ্চ ৯৫ লাখ টাকা দর দিয়েছেন মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আতিকুর রহমান।
মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিং হাটটি প্রথম পর্যায়ের ইজারায় বিএনপি ও জামায়াতের দুই নেতা ২ কোটি টাকা সমমূল্য দেওয়ায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ইজারা অনুষ্ঠিত হয়। হাটটি এবার সর্বোচ্চ দরে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকায় পেয়েছেন মেসার্স সোহাগ এন্টারপ্রাইজের রতন মিয়া। তবে এই ইজারাদারের সঙ্গে জামায়াত ও বিএনপির নেতারা জড়িত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
মোহাম্মদপুরের বছিলার পশুর হাটটিতে সর্বোচ্চ ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা দর দিয়েছেন মোহাম্মদপুর থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জালাল মৃধা। ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাঁচকুড়া বাজারসংলগ্ন রহমাননগর আবাসিক এলাকার হাটের ইজারায় সর্বোচ্চ ১৩ লাখ টাকায় আরহাম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী বিএনপি নেতা শাহ মিরাজ দর দিয়েছেন।
ভাটারা সুতিভোলা খালসংলগ্ন হাটটিতে তামিম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম সরকারি মূল্যের চেয়ে ৭০ লাখ টাকা কমে সর্বোচ্চ ৩ কোটি টাকা দর দিয়েছেন।
ডিএসসিসির ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডে কামরাঙ্গীরচরে চলতি বছর কোনো গরুর হাটের ইজারা দেয়নি সিটি করপোরেশন। তবে এই জায়গায় যুবদল নেতা সোহেল আরমান ও বিএনপি নেতা মনির চেয়ারম্যান মিলে অবৈধ গরুর হাট বসিয়েছেন। কলাবাগান কলোনির মাঠে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা আরেকটি হাট বসিয়েছেন।
এদিকে গাবতলীর স্থায়ী পশুর হাটের ইজারা নিয়েও চলছে নানা জটিলতা। গত ৩ মার্চ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর সর্বোচ্চ সোয়া ২২ কোটি টাকা দর দিয়েছিল মেসার্স আরাত মোটরস নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এটি নির্ধারিত দরের চেয়ে ৭ কোটি টাকা বেশি। সঙ্গে আরও ২৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর ও আয়কর রাজস্ব খাতে যুক্ত হতো।
কিন্তু সর্বোচ্চ দরদাতাকে হাটের ইজারা না দিয়ে ডিএনসিসি হাটটিতে খাস আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এ ঘটনায় সম্প্রতি দুদক ডিএনসিসিতে অভিযান চালিয়ে কাগজপত্র জব্দ করে। পরে গাবতলী হাটের ইজারা বিজ্ঞপ্তি দেয় করপোরেশন।
জানা যায়, গত বুধবার গাবতলী হাট ইজারার জন্য সর্বোচ্চ ২৫ কোটি টাকা দর দিয়েছে টিএইচ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ট্রেড লাইসেন্স অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির মালিক আলী হায়দার নামে এক ব্যক্তি। ইজারাপ্রত্যাশী অন্য দরদাতাদের প্রতিনিধিরাও টিএইচ এন্টারপ্রাইজের মালিক আলী হায়দারকে চিনতে পারছেন না।
তার রাজনৈতিক পরিচয় আছে কি না, তা মিরপুরের স্থানীয় বিএনপি নেতারা জানাতে পারেননি। তবে জানা যায়, এনসিপির নেতারা এই হাটের জন্য তাদের পছন্দের ঠিকাদারকে সুপারিশ জানান।
সার্বিক বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ৯ হাটের মধ্যে ছয়টির দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি চূড়ান্ত করার পর সবাইকে কার্যাদেশ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি তিনটি সরকারি মূল্যের চেয়েও কম পাওয়ায় মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে যে সিদ্ধান্ত দেবে, আমরা সেভাবেই কাজ করব। তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে বলা যায়, এবার পশুর হাটের বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে।