বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


বিশ্ব ডেস্ক

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২৫, ১০:৪৩ এএম

ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিলেন যে বাংলাদেশি পাইলট

বিশ্ব ডেস্ক

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২৫, ১০:৪৩ এএম

‘লিভিং ঈগল’ খ্যাত সাইফুল আজম। ছবি- সংগৃহীত

‘লিভিং ঈগল’ খ্যাত সাইফুল আজম। ছবি- সংগৃহীত

১৯৬৭ সালে ৫ জুন চারটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাটিতে হামলা করে যার পর শুরু হয় ৬ দিনব্যাপী যুদ্ধ। পূর্বেই মিশরের বিমান বাহিনী হামলা করেছিল ইসরায়েল। মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই মিশরের দুইশ’রও বেশি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে ইসরায়েল। অভিযানে ইসরায়েলের দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়। যার একটি ভূপাতিত করেছিল বাংলাদেশি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম।

৫ জুন জর্ডানের বিমান উড়িয়ে সফলতার সাথে এসব ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিলেন তিনি। ৬ ও ৭ জুন ইরাকের পক্ষ থেকে বিমান চালিয়ে আরও দুটি ইসরায়েলি জেট ভূপাতিত করেন তিনি।

এর আগে, ১৯৬৫ সালের ভারত‑পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন পাইলট হিসেবে, তিনি ভারতের একটি যুদ্ধবিমানও ভূপাতিত করেন।

সাইফুল আজম পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে ১৯৬০ সালে কমিশন লাভ করেন, পরে ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দেন । ২০০০ সালে, তাকে ‘বিশ্বের ২০ জন জীবিত ফ্লাইং অ্যাসের’ একজন হিসেবে সম্মান দেওয়া হয়।

পাকিস্তান থেকে জর্ডান

‘দ্য গোল্ড বার্ড: পাকিস্তান অ্যান্ড ইটস এয়ার ফোর্স, অবজারভেশনস অফ আ পাইলট’ বইয়ে মনসুর শাহ লিখেছেন, ‘আমাদের (পাকিস্তানের) বিমান বাহিনীর টেকনিশিয়ানদের ৩৫ শতাংশ এবং সাইফুল আজমের মতো চমৎকার পাইলটসহ বিমানচালকদের এক-চতুর্থাংশ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের।

পাকিস্তানের ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের পদে থাকাকালীন ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করার পর তাকে পাকিস্তান সরকার সামরিক পদক ‘সিতারা-ই-জুরাত’ দিয়ে সম্মানিত করে।

এর পর ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে তিনি জর্ডান বিমান বাহিনীর উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত হন। পরের বছর আরও একটা যুদ্ধে লড়েন তিনি। ওই যুদ্ধে একদিকে ছিল ইসরায়েল, অন্যদিকে জর্ডান, মিশর, সিরিয়া ও ইরাকসহ আরব দেশগুলোর জোট।

ইতিহাসবিদ ও সাবেক এয়ার কমোডর কায়সার তুফায়েল তার ‘গ্রেট এয়ার ব্যাটলস অফ পাকিস্তান এয়ার ফোর্স’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে আকাশ প্রতিরক্ষার সীমিত অনুমতি পাওয়ার পর সাইফুল আজম জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটি থেকে লেফটেন্যান্ট এহসান শারদুমকে নিয়ে হান্টার বিমানে সওয়ার হয়ে উড়ান শুরু করেন। তাদের পেছনে পেছনে অন্যান্য হান্টার বিমানও উড়তে শুরু করে।’

ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ধ্বংস

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, ‘মরুভূমির ধুলাবালি এবং উত্তাপের কারণে, দৃষ্টিশক্তি এক মাইলেরও কম ছিল। শত্রুর কোনও চিহ্নই দেখা যাচ্ছিল না। সাইফুল রাডারে মাফরাক বিমানঘাঁটির দিকে ইসরায়েলি বিমান আসছে কি না জানতে চাইলে, জবাব আসে ‘হ্যাঁ’। সঙ্গে সঙ্গে মাফরাকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন সাইফুল।’

জর্ডানের আশঙ্কা ছিল, মিশরের পর ইসরায়েলি বিমানবাহিনী সেখানে হামলা চালাবে।

কায়সার তুফায়েল আরও লিখেছেন, ‘তিনি মাফরাক বিমানঘাঁটি থেকে চার মাইল দূরে চারটে বিমানকে কম উচ্চতায় যুদ্ধবিন্যাসে উড়তে দেখেন। অনুমান করেন যে এটা ইসরায়েলি মিস্টেয়ার বিমান।’

‘সাইফ সঙ্গে সঙ্গে এমন এক বিমানের ঠিক পেছনে অবস্থান নেন যেটা হামলার জন্য ধেয়ে যাচ্ছিল। তিনি শক্তিশালী বন্দুক দিয়ে গুলি করেন ওই বিমানে। মিস্টেয়ার বিমানে আগুন লেগে যায় এবং তার বিভিন্ন অংশগুলো ভেঙে যেতে শুরু করে। ওই বিমানের ভেঙে পড়া অংশগুলো এড়াতে সাইফুল তার নিজের বিমানকে বেশি উচ্চতায় নিয়ে যান।’

‘মাফরাক বিমানঘাঁটির সীমান্তের কাছে ওই ইসরায়েলি বিমান ধ্বংস হয়। কিন্তু তার পাইলট লেফটেন্যান্ট হানানিয়া বিমান থেকে বের হতে পারেননি।’

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম দেখলেন দু'টো মিস্টেয়ার বিমান পূর্ণ গতিতে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। সাইফুল তাকে ধাওয়া করতে করতেই এহসান তার ডান দিকে আরেকটা শত্রু বিমানকে লক্ষ্য করেন। তিনি এহসানকে একটা শত্রু বিমানকে ধাওয়া করার নির্দেশ দেন আর নিজে অন্য দু'টো শত্রু বিমানের পিছনে ধাওয়া করেন।’

‘সাইফুল একটা মিস্টেয়ারের পিছনে চলে আসেন, যে বিমানটা দ্রুত সমারসল্ট করে পালানোর চেষ্টা করছিল। সাইফুল ওই বিমানকে লক্ষ্য করে চারবার গুলি ছুঁড়লেও তার কোনোটাই লক্ষ্যে লাগেনি।’

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, ‘তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু হঠাৎই লক্ষ্য করেন যে শত্রু বিমান সোজা উড়তে শুরু করেছে। ব্যবধান কমিয়ে পঞ্চমবার নিশানা করেন সাইফুল। এইবার মিস্টেয়ারের ডান দিক থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করে। অর্থাৎ গুলি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত লেগেছে।’

‘ওই বিমানটা কাত হয়ে যায়, কিন্তু তা পুড়োপুরো ধ্বংস হয়েছে কি না তা দেখতে পাননি সাইফুল কারণ ততক্ষণে অন্য একটা ইসরায়েলি বিমান তাকে আক্রমণ করার জন্য ঘুরছিল।’

কায়সার তুফায়েল আরও লিখেছেন, ‘জ্বালানি ও গোলাবারুদের অভাবে সাইফুল পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন এবং মাফরাকে ফিরে আসেন। তার আশঙ্কা ছিল, মাফরাকের রানওয়ে হয়তো কাজ করার মতো অবস্থাতে নেই। তাই তিনি সমস্ত বিমানকে এয়ারফিল্ডের উত্তরে অপেক্ষা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাদের রানওয়েতে অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়।’

‘কিন্তু এহসান বিপদ বুঝতে পেরে রেডিওতে নিয়ন্ত্রকের পরিচয় এবং তার কুকুরের নামও জানতে চান, যা আসলে একটা গোয়েন্দা কোড ছিল। সেই সময়েই একই, জর্ডানের নিয়ন্ত্রক রেডিওতে এসে মাফরাকে অবতরণ না করার জন্য সতর্ক করেন।’

এহসান শারদুমের উপস্থিত বুদ্ধি তাদের দু'জনকেই এই বিপজ্জনক ইসরায়েলি ফাঁদ থেকে রক্ষা করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ওই রানওয়ে ততক্ষণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং অবতরণ করার জন্য অনুমতির রেডিও বার্তা আসলে একটা ফাঁদ ছিল।

‘সব বিমানকে রাজধানী আম্মানের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে তখনো ইসরায়েলিরা হামলা চালায়নি। ভাগ্যবশত পাইলটরা হামলার কিছুক্ষণ আগে অবতরণ করে।’

‘কিন্তু তাদের বিমানগুলো রক্ষা পায়নি। অবতরণের কিছুক্ষণ পরেই আধুনিক সুপার-মিস্টিক প্লেনগুলো ‘ডাইবার’ বোমা ব্যবহার করে আক্রমণ চালায়, যার ফলে রানওয়ের ব্যাপক ক্ষতি হয়।’

জর্ডানের শাহ এবং ইরাকি বিমান বাহিনী

কায়সার তুফায়েল তার বইয়ে লিখেছেন, ‘বিমানবন্দরের সিভিল সেন্টারগুলোকেও লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই হামলায় বহু বিমান ও হেলিকপ্টারও ধ্বংস হয়। পাইলটরা এই ঘটনার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করার জন্য আম্মানের অপারেশন হেডকোয়ার্টারে জড়ো হন।’

‘প্রায় এক ঘণ্টা পর তাদের মাঝে উপস্থিত হন স্বয়ং জর্ডানের বাদশাহ হুসেইন। তিনি পাইলটদের প্রশংসা করতে এসেছিলেন যারা এই প্রথম জর্ডানের কোনো বড় বিমান যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।’

কায়সার তুফায়েল জানিয়েছেন, এই সময় জর্ডান তার পাইলটদের ইরাকে পরিষেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন। তারপর শীঘ্রই তাদের ইরাকে পাঠানোর আদেশও জারি করা হয়।

এরপর ছয়ই জুন রাত নয়টায় ওই কনভয় ইরাকের হাবানিয়া বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছায়, যেখানে তিনটে হান্টার স্কোয়াড্রন উপস্থিত ছিল।

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, ‘সাতই জুন সকালে খুবই নিচু গলায় কারও কোথায় ঘুম ভাঙে সাইফুলের। বেস কমান্ডারের বার্তা নিয়ে তার কাছে পৌঁছান ইরাকের একজন তরুণ অফিসার। ওই বার্তায় জানানো হয়েছিল তিনি (বেস কমান্ডার) প্রথম ফ্লাইটের জন্য চারজন পাইলটকে এগিয়ে আসতে বলেছেন এবং আপনাকে নেতৃত্ব দিতে বলা হয়েছে!’

এয়ারবেস এইচ-থ্রি

এর কিছুক্ষণ পরই চারটে হান্টার বিমানের একটা দল বাগদাদ থেকে ৪৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ইরাকের পশ্চিমাঞ্চলীয় মরুভূমির এক প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত বিমানঘাঁটি এইচ-থ্রি এর দিকে যাচ্ছিল।

‘পঁচিশ হাজার ফুট উচ্চতায় কন্ট্রোলার ঘোষণা করেন-লিডার, এইচ-থ্রি আক্রমণ করা হচ্ছে। নিচে যান এবং মোকাবিলা করুন।’

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, ‘ইসরায়েলি বিমানের ফরমেশনে ছ'টা বিমান ছিল। ওয়াভাতোরের চারটে বিমানের নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি স্কোয়াড্রন কমান্ডার ক্যাপ্টেন সোলেমন করণ, যিনি টু-সিটারর বিমানে নেভিগেটর ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডার আনবার মেলিৎজারের সঙ্গে ছিলেন।’

অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রামাত ডেভিড বিমানঘাঁটির বেস কমান্ডার কর্নেল ইয়েজিকাল সমিক, ক্যাপ্টেন আইজ্যাক গ্যালান্টিজ-গোলান এবং লেফটেন্যান্ট ওশলম ফ্রিডম্যান।

‘সাইফুল আজমের নেতৃত্বাধীন ইরাকি হান্টার বিমান যখন এইচ-থ্রি থেকে পাঁচ মাইল দূরে, তখন তারা পশ্চিম দিক থেকে দু'টো ওয়াভাতোর বিমান আসতে দেখেন। সাইফুল যখন ওয়াচ টাওয়ার বিমানের পেছনে যাওয়ার জন্য পজিশন নিচ্ছিলেন, তখন সমীর তাকে ডেকে বলেন-দু'টো মিরাজ বিমান তোমার পেছনে আছে।’

‘এক মুহূর্তের মধ্যে, সাইফুল তার ফর্মেশন ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন, তিনি এবং এহসান ওই মিরাজ বিমানগুলোর মোকাবিলা করবেন বলে স্থির করেন। সমীর ও গালিব ধাওয়া করবে ওয়াভাতোরকে।’

কায়সার তুফায়েলের মতে, ‘সাইফুল দ্রুত ব্যবধান কমিয়ে আনেন। তারপর বিসমিল্লাহ বলে হান্টার বিমানের ট্রিগারে চাপ দিয়ে একটা মিরাজকে টার্গেট করেন। গুলি সরাসরি ইসরায়েলি বিমানের ডানায় আঘাত করে এবং স্ফুলিঙ্গ দেখা যায়।’

‘হঠাৎ আঘাতে মিরাজ ভস্মীভূত হয় এবং ইসরায়েলি পাইলট ক্যাপ্টেন ডারভার বিমান ঘাঁটির কর্মীদের সামনে ইজেক্ট করে বেরিয়ে আসেন। মিরাজ ধ্বংস করার পর সাইফুল ডান দিকে মোড় নিয়ে দেখেন প্রায় দুই হাজার ফুট নিচে দিয়ে যাচ্ছে আরেকটা শত্রু বিমান।’

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, ‘সাইফুল নিজের বিমানকে উল্টে দেন এবং একটা স্প্লিট-এস মুভমেন্ট করতে থাকেন। মাটি থেকে কম উচ্চতাতে এই মুভমেন্ট বিপজ্জনক হতে পারে। এত জোরে টান দেন তিনি যে তার প্রত্যাঘাতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন সাইফুল। বিমান পৃষ্ঠে এসে পড়ার পর তিনি লক্ষ্য করেন তার বিমান ওয়াভাতোরের পিছনে। যদিও তখনও ব্রেক খোলা ছিল এবং থ্রটল বন্ধ ছিল। সেই সময় ওই বিমানের সঙ্গে তার দূরত্ব মাত্র দু'শো ফুট।’

‘সাইফুল গুলি চালান। তার আঘাতে ওই বিমান টুকরো টুকরো হয়ে আকাশে উড়তে শুরু করে। সাইফুলের নিজের বিমানও এমনভাবে ঝাঁকুনি খায় যেন কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে।’

কায়সার তুফায়েলের মতে, ‘ক্যাপ্টেন গোলান বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং তার বিধ্বস্ত বিমান থেকে প্যারাসুটের সাহায্যে বেরিয়ে আসেন। ডারভার কিছুক্ষণ আগেই আরও বেশি উচ্চতা থেকে থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। গোলানের প্যারাসুট যখন খোলে তখন দু'জনেই এখন একসঙ্গে প্যারাসুটের সাহায্যে আকাশে ভাসছেন।’

সাইফুলের বিমানের জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় যখন তিনি ফিরে আসার পরিকল্পনা করছিলেন, তখন সমীর উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, লিডার, আমি ওয়াভাতোরকে ধ্বংস করেছি।

কায়সার তুফায়েলের লিখেছেন, ‘এহসানও জানায় যে সেও একটা ওয়াভাতোর ধ্বংস করেছে। সাইফুল যখন পুরানো ফর্মেশনে ফিরতে শুরু করেন তখন লক্ষ্য করেন একটা মিরাজ (ক্যাপ্টেন দোতানের বিমান) কোনো বিমানকে তাড়া করছে। সেটা গালিবের বিমান ছিল এবং সেখান থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছিল। রেডিও মারফত সবাই পালা করে তাকে ইজেক্ট করতে বললেও তিনি নিশ্চুপ থাকেন।’

‘এয়ারফিল্ডের কাছে একটা পরিত্যক্ত তেলের ট্যাংকের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় ওই বিমানের।’

এইচ-থ্রি অভিযানের সমালোচনা

‘সব বিমানের জ্বালানি ফুরিয়ে গিয়েছিল কারণ তারা আগেই অতিরিক্ত ট্যাংক ফেলে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও সাইফুল এবং এহসান হাবানিয়া বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছান, তাও আবার অনেক উচ্চতায় উড়ান ভরার পর।’

‘সাইফুল বিমান থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন তাকে নিয়ে উদযাপনে মেতে ওঠে। সবাই স্লোগান দিচ্ছিল। সাইফুলের চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। তিনি আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন। একইসঙ্গে তরুণ গালিবের জন্যও প্রার্থনা করছিলেন, যার সঙ্গে মিশনের মাত্র আধ ঘন্টা আগে দেখা করেছিলেন তিনি।’

ইসরায়েলি বিমানবাহিনী অসংখ্য সাফল্য অর্জন করলেও এইচ-থ্রি অভিযানের পর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে।

কর্নেল এলিয়াজার কোহেন তার ‘বেস্ট ডিফেন্স অব ইসরায়েল’ বইয়ে লিখেছেন, ‘এইচ-থ্রির সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হলেও আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিশাল। একজন পাইলট এবং নেভিগেটরের মৃত্যু হয়েছিল, দু'জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তিনটে বিমান ধ্বংস হয়েছিল।’

এরপর জর্ডান সরকার সাইফুল আজমকে ‘উইসাম আল-ইসতিকলাল’, ইরাক ‘নুত আল-সুজাত’ এবং পাকিস্তান ‘সিতারা-ই-বাসালাত’ পদক দিয়ে সম্মানিত করে। এর আগে পাক-ভারত যুদ্ধে একটা ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করার পর তাকে ‘সিতারা-ই-জুরাত’ পদক দেওয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগদান

এরপর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে চলে যান তিনি এবং সেখানে বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ২০০১ সালে ‘লিভিং ঈগল’ হিসেবে তার নাম ইন্টারন্যাশনাল হল অফ ফেম-এর অন্তর্ভুক্ত হয়।

পাকিস্তান বিমান বাহিনী ম্যাগাজিনের ‘সেকেন্ড টু নান’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে এয়ার কমোডর মোহাম্মদ আলী লিখেছেন, ‘সাইফুল আজম চারটে দেশের (পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক ও বাংলাদেশ) বিমান বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং দুই দেশের (ভারত ও ইসরায়েল) বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছেন।’

অবসরের পর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে পাবনা থেকে অংশ নিয়ে তিনি সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার শহীদুল ইনাম খান তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, সাইফুল আজমের সাহসিকতা ইসরায়েলেও প্রশংসিত হয়। ২০২০ সালের জুন মাসে তার মৃত্যুর পর বিষয়, প্রধান সংবাদপত্রগুলো সাইফুল আজমের বিষয়ে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করেছিল।

শহীদুল ইনাম খান লিখেছিলেন, ‘১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে যখন একটা ইসরায়েলি বিমানকে নিশানা করেছিলেন সাইফুল, তখন সরাসরি আক্রমণ করার বদলে পাশ থেকে নিশানা করেন এবং বিমানের লেজে গুলি করেন। ইসরায়েলি পাইলট প্রাণে বেঁচে যান। প্যারাসুটের সাহায্যে অবতরণ করেন তিনি।’

মি খান লিখেছেন, ‘পাইলট পরে জানান, তিনি যখন নিচে নামছিলেন, তখন সাইফুল রোল অ্যান্ড লুপ দিয়ে তার দিকে হাত নাড়েন এবং এরপর তিনি আরেকটা ইসরায়েলি বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করার জন্য ধেয়ে যান। সাইফুল না চাইলে ওই পাইলট বাঁচতেন না।’

জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ছয় দিনের যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু ততদিনে ইসরায়েল গোলান মালভূমি, গাজা, সিনাই উপদ্বীপ ও পশ্চিম তীর (পূর্ব জেরুজালেমসহ) দখল করে নেয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পুরোপুরি বদলে দেয়।

তবে এই লড়াই সাইফুল আজমের কীর্তির জন্য আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।

তথ্য সূত্র- বিবিসি বাংলা

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!