জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে প্রতারণার মাধ্যমে অনেকেই টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কোনো কোনো প্রতারকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আবার কারো কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকে এখনো প্রতারণার দায়ে জেলে আছেন।
এমনকি প্রকৃত নিহতের পরিবার থেকেও প্রতারণা করে একাধিকবার অর্থ নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি এখন এই ফাউন্ডেশনের জন্য অস্বস্তিকর বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে নিহত মো. আতিকুর রহমানের মা প্রতারণা করে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বরিশালের হিজলা উপজেলার ইউএনও ইলিয়াস হোসেনকে টাকা উদ্ধারে দায়িত্ব দেওয়া হলেও আতিকের বাবা নাসির উদ্দিন ও মা নুরজাহান বেগম তা দিতে অস্বীকার করেন। বিষয়টি এখন অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের ঘটনা হলেও এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অথচ অহতদের মধ্যে যারা প্রতারণা করে অর্থ নিয়েছে, তাদের অনেকের নামেই মামলা করা হয়েছে।
এই বিষয়ে হিজলা উপজেলার ইউএনও ইলিয়াস হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিষয়টি সমাধান করার জন্য জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি বিষয়টি সমাধান করার জন্য আতিকের বাবা-মা ও ভাই মো. সোলাইমানকে ডেকে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য বলেছেন। কিন্তু তারা টাকা ফেরত দিতে অস্বীকার করে বলেছে, বিষয়টি জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে সমাধান করবে। তবে বিষয়টি এখন বরিশাল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
ঘটনার সময় জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের দায়িত্বে ছিলেন মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। কিন্তু বর্তমানে তিনি দায়িত্বে না থাকায় প্রতারণার এই বিষয়ে ফাউন্ডেশনের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে যতটুকু জানা গেছে, ফাউন্ডেশন টাকা উদ্ধারের এখন পর্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে ভবিষ্যতে ফাউন্ডেশনের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন আসতে পারে।
জানা গেছে, জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের আর্থিক অনুদানের জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে নিহত মো. আতিকুর রহমানের স্ত্রী মহুয়ার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। এ জন্য আতিকের জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার ব্যবহার করা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে আতিকের বাবা-মা আতিককে অবিবাহিত দেখিয়ে সরাসরি জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জন্মসনদ দিয়ে তালিকাভুক্ত হয় এবং ৫ লাখ টাকা অনুদান তুলে নেয়। যার চেক নাম্বার- এসকিউ-৫০ ৯৭২১১৯৫। আর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হওয়া আতিকের স্ত্রীকে অনুদানের ৮০ শতাংশ দেওয়া হয় ৪ লাখ টাকা। যার চেক নাম্বার- এসকিউ-৫০ ৯৭২১৩৯৪ এবং আতিকের বাবা-মাকে অনুদাদের ২০ শতাংশ দেওয়া হয় ১ লাখ টাকা। যার চেক নাম্বার- এসকিউ-৫০ ৯৭২১৩৯৫।
আতিকের স্ত্রীর অনুদাদের ২০ শতাংশ আর প্রতারণার মাধ্যমে নেওয়া ৫ লাখ টাকার চেক আতিকের মা নুরজাহান বেগমের নামে ইস্যু করা হয়। দুইটি চেক একই নামে হওয়ায় বিষয়টি জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের নজরে আসে। এরপরই টাকা উদ্ধারে উদ্যোগী হয় এই ফাউন্ডেশন। যার সমাধান এখনো হয়নি। একইভাবে ৫ থেকে ৭টি পরিবার একাধিকবার টাকা নিয়েছে। যার কোনো সমাধান হয়নি। কারো কারো ক্ষেত্রে এমনও ঘটনা ঘটেছে, ফাউন্ডেশন তাদের বিষয়ে জেনেও না জানার ভান করেছে। ওই সব পরিবার মূলত ফাইন্ডেশনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে নিহত হয়েছেন সংবাদকর্মী মো. আতিকুর রহমান। তার কন্যা আদিবা আর পুত্র মো. আবদুল্লাহকে নিয়ে স্ত্রী মহুয়া বিধবা হয়ে শ্বশুর নাসির উদ্দিন ও শাশুড়ি নুরজাহান বেগমের কাছে আশ্রয় নেন। কিন্তু মহুয়ার শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। এমনকি নাতি-নাতনিকে অস্বীকার করে এই দুই শিশুর অভিভাবকত্ব দলিল করে তাদের মামা মো. নোমান হোসেনের কাছে দিয়ে দেন। দলিলের চুক্তি অনুযায়ী মহুয়া তাদের সন্তানসহ শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবে না। তারা এই শিশুদের কোনো দায়িত্বও নেবে না। কিন্তু সরকার জুলাই-আগস্টের আহত-নিহতদের আর্থিক অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর আতিকের মা-বাবা ও ভাই বিভিন্ন ছলনার আশ্রয় নেন। এমনকি আতিকের সঞ্চয় করা সাড়ে ৪ লাখ টাকাও ফেরত দেয়নি তারা। যা দলিলে ফেরত দেওয়ার কথা উল্লেখ করা আছে। সম্প্রতি বরিশাল জেলা পরিষদ থেকে নিহতদের ২ লাখ টাকার যে অনুদান দিয়েছে, সেখান থেকেও তারা আতিকের স্ত্রীর কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা নিয়েছে।
এই বিষয়ে আতিকের স্ত্রী মহুয়া বলেন, আতিকের মৃত্যুর পর শ্বশুর-শাশুড়ির আশ্রয়ে গেলে তারা সন্তানসহ তাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেন। এমনকি সন্তানদের দায়িত্ব নিতেও তারা রাজি না। বিষয়টির আইনি ভিত্তি দিতে তারা একটি দলিল করে। যেখানে দায়িত্ব না নেওয়ার কথা লেখা হয় এবং দলিলে তার ভাইকে অভিভাবক হিসেবে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে তাকে তা মেনে নিতে হয় এবং ভাইয়ের আশ্রয়ে যেতে হয়।
তিনি বলেন, সম্পর্ক ছিন্ন করার পরও আতিকের বাবা-মা ও ভাই সব অনুদান বা সহায়তা নিয়ে নিয়েছেন। এমনকি আতিকের জমানো টাকাও তারা ফেরত দেয়নি। সরকার যদি সহায়তা না করত, তাহলে তাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে যেত। বিজনেস পোস্টের গ্রাফিক্স ডিজাইনার আতিকের মৃত্যুর পর তার বাবা-মা তাদের অস্বীকার করে আশ্রয়টা পর্যন্ত দেননি। এমনকি নানাভাবে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেছেন। এ বিষয়ে মূল ভূমিকায় ছিল তার দেবর মো. সোলাইমান।
জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে ১৫ এপ্রিল ইলিয়াছ যে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, তাতে বলেছেন, ৭ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা তাকে ডেকে নিয়ে মারাত্মক জখম করেন। আসলে তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত হননি। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে গণঅভ্যুত্থানে আহত হিসেবে সরকারি তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
প্রতারণার অভিযোগে ১৬ এপ্রিল রাজধানীর রমনা মডেল থানায় জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষে প্রধান গ্রাহকসেবা কর্মকর্তা মো. মাহফুজুর রহমান দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। দুজন হলেন ইলিয়াছ ও মোহাম্মদ লিটন। এই মামলায় লিটনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। ফাউন্ডেশনের করা মামলায় ১৭ এপ্রিল লিটনের জামিন নামঞ্জুর হয়।
ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ইলিয়াছ ও লিটন প্রতারণা করেছেন। তারা ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা নিয়েছেন।