বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২৫, ১২:১০ পিএম

কর্মীর নামে মালিকের ১২৪ কোটি টাকা ঋণ 

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২৫, ১২:১০ পিএম

কর্মীর নামে মালিকের ১২৪ কোটি টাকা ঋণ।      ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

কর্মীর নামে মালিকের ১২৪ কোটি টাকা ঋণ। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

এনআরবিসি ব্যাংক থেকে নিজের বেতনভুক্ত দুই কর্মচারীর নামে ধাপে ধাপে ১২৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন মোহাম্মদ আদনান ইমাম। একই ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান থাকায় এক্সোরা অ্যাপারেলসের আগের মালিক ও দুই কর্মচারীর নামে পোশাক কারখানার বিপরীতে এই ঋণ অনুমোদন করা হয়। তবে যাদের নামে কোম্পানি গঠন ও ঋণ নেওয়া হয়েছে, তারা কেউ বিষয়টি জানতেন না। এই গোপন ঋণের ফাঁদে পড়া তিনজন সরকারের কাছে প্রমাণসাপেক্ষে সুবিবেচনা ও অপরাধীর শাস্তি দাবি করেছেন।

এদিকে খেলাপি ঋণের ১২৪ কোটি টাকা আদায়ে চতুর্থবারের মতো চিঠি পাঠিয়েছে এনআরবিসি ব্যাংকের উত্তরা শাখা। পোশাক রপ্তানি আয়ের বিপরীতে অবৈধ পাচারকে সাধারণ ঋণ হিসেবে গণ্য করেছে ব্যাংকটি। অর্থ আদায়ে ব্যাংক মামলার হুমকি দিলে দিগভ্রষ্টভাবে ছুটছেন কথিত ঋণগ্রহীতা পরিচালকেরা। তবে ব্যাংক ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় সম্প্রতি ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা করা হয়েছে।

সরকার পরিবর্তনের পর যুক্তরাজ্যের নাগরিক আদনান ইমামের পরিবার এখন সেখানেই অবস্থান নিয়েছে। আইপিই গ্রুপের পাঁচ সহযোগীর মাধ্যমে কয়েকটি ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে যুক্তরাজ্যে ৩৪টির বেশি ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি, যার দাম কয়েকশ বিলিয়ন পাউন্ড। একই সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ৭০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ভিলা ও কটেজ স্ত্রী নাদিয়া মোমিন ইমামের নামে কিনেছেন তিনি।

ঋণের বিপরীতে এক্সোরা অ্যাপারেলসের গাজীপুরের কাশিমপুরে ৪৩ শতাংশ জমি ও বন্ধ ফ্যাক্টরির কলকবজা ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ রয়েছে। তবে জমিসহ ফ্যাক্টরির ভ্যালুয়েশন এখনো করা হয়নি। করোনার আগে কোম্পানির উৎপাদন ও রপ্তানি বেশ ভালো ছিল।

২০২৩ সালে দুবার ‘বিনলক’ হলে তা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এই সময়ে রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় কোম্পানি বিশাল ক্ষতির মুখে পড়ে বলে জানিয়েছে এনআরবিসি ব্যাংকের উত্তরা শাখা।

ঋণের বিষয়ে এনআরবিসি ব্যাংক, উত্তরা শাখার ব্যবস্থাপক গোলাম মোহাম্মদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘মালিকানায় কেÑ এটা তাদের বিষয়। তবে ঋণ আদায়ে দুই-এক দিনের মধ্যে গ্রহীতাকে ৩০ দিনের সময় দিয়ে লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হবে। তার পরে অর্থঋণ আইন অনুযায়ী আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেবে ব্যাংক।’

অনুসন্ধানকালে আদনান ইমামের পরিবারের দেশ-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদের দীর্ঘ তালিকা দেখে হতবাক হয়েছেন অনেকেই। পাচারে সহযোগী পাঁচজনের অবৈধ সম্পদ অর্জন, ১৭টি কোম্পানি ও কাগুজে কোম্পানির নামে আদনানের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রহণ ও পাচারের বিশেষ নথি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বাংলাদেশ ও বিদেশে থাকা এসব সম্পদ দ্রুত হস্তান্তরের চেষ্টা করছে আদনান পরিবার।

বিদেশে নিজের ও স্ত্রীর (যুক্তরাজ্যের পাসপোর্টধারী) নামে সম্পদ কেনেন লন্ডনের এই আবাসন ব্যবসায়ী। এ ছাড়া ঢাকার আশুলিয়া, উত্তরা, গুলশানে একাধিক ভবন, চট্টগ্রামের খুলশি, পাহাড়তলী ও গ্রামের বাড়ি পটিয়ায়ও বিপুল পরিমাণ সম্পদ কেনেন এই বিদেশি নাগরিক।

ঢাকার উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের তৃতীয় প্রকল্পে বোন জাহারা রাসুলের নামেও প্লট কিনেছেন তিনি। পরিবারের প্রত্যেকে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের নাগরিক এবং একাধিক পাসপোর্টের অধিকারী।

নিজের বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণের ‘গ্যারান্টার’ হিসেবে গোপনেই যুক্ত করেছেন তার কোম্পানির অনেক কর্মকর্তাকে। যদিও নিজের বেশির ভাগ ভূসম্পদ ঋণের বিপরীতে ব্যাংককে জামানত দেননি।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের চেয়ারম্যানও আদনান ইমাম। সেই কোম্পানির শীর্ষ এক কর্মকর্তা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবিএল) গুলশান শাখায় প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ঋণের গ্যারান্টার। এই অর্থ উদ্ধারে শিগগিরই মামলা করতে যাচ্ছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। 

এরই মধ্যে ঋণের দায়ে আদনান ইমামের ১৫ কোটি টাকার একটি গাড়ি (বেন্টিল, চট্ট-মেট্রো-ভÑ১১Ñ১১১১) আটক করা হয়েছে। বেনামি কোম্পানি ফুলপুর এগ্রো লিমিটেডের নামে গাড়িটি ইউসিবির কারওয়ান বাজার শাখায় ঋণ করে কেনা হয়। আরও একটি গাড়ি (চট্ট-মেট্রো ১২-১২১২) আটক করতে সন্ধান করছে ইউসিবি কর্তৃপক্ষ।

তবে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ‘ঋণখেলাপি’ কর্মচারীরা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, তারা কর্মচারী হিসেবে মোহাম্মদ আদনান ইমামের ‘আইপিই’ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ঋণ গ্রহণের বিষয়ে কখনোই তারা কোনো ব্যাংক বা বাংকের কর্মীর কাছে যাননি। এমনকি কোনো ঋণপত্রেও তাদের স্বাক্ষর নেই বলে তারা দাবি করেন। তবু তাদের নামে শত কোটি টাকার বেশি ঋণ অনুমোদন দিয়েছে ব্যাংক।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২১ সালে রেজিস্ট্রেশন করা ১০ লাখ টাকা মূলধনের ভাইব্রেনিয়াম কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে বদরুল হাসান পাটওয়ারী এবং পরিচালক হিসেবে খাইরুল ইসলাম জোয়ার্দ্দারকে দেখানো হয়েছে।

সেই ভাইব্রেনিয়ামের মাধ্যমে ইক্সোরা এ্যাপারেলস লিমিটেড অধিগ্রহণ করা হয়। চেয়ারম্যান বদরুল হাসান ৮৩ শতাংশ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ রানা ১৫ শতাংশ ও পরিচালক খাইরুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার (আদনান ইমামের চাচাতো বোনের স্বামী) ২ শতাংশ শেয়ারের মালিক। নিবন্ধনের এক মাসের মধ্যে ৭৮ হাজার বর্গফুটের কারখানায় ৮০০টি যন্ত্রপাতিসহ (প্রতিদিন ৮ হাজার পিস উৎপাদন সক্ষম) ইক্সোরা অধিগ্রহণ করা হয়।

আরজেসি জানিয়েছে, কোম্পানি অধিগ্রহণকালে ১০০ শতাংশ শেয়ার মূল্য ইক্সোরা অ্যাপারেলসের কথিত মালিকদের ব্যাংক হিসাব থেকে হস্তান্তর হয়নি। আইপিই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদনানের হিসাব থেকে অর্থ হস্তান্তর করা হয়েছে। গ্রুপের চেয়ারম্যান বাবা চৌধুরী ফজলে ইমাম, মা নিলুফার ইমাম ও বোন জাহারা রাসুলকে এখানে যুক্ত করা হয়নি বলে জানিয়েছে আরজেসি।

তবে সরকার পরিবর্তনের পরে ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে আদনান ইমাম লন্ডনে দেশান্তরী হলে প্রায় ১ হাজার কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের চার মাসের বেতন বকেয়া রেখে বিনা নোটিশে গাজীপুরের ফ্যাক্টরি বন্ধ করে কর্তৃপক্ষ।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়েছে, ইক্সোরা অ্যাপারেলস থেকে (২০১৮-২০২০ সাল) ৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা পোশাকের ১২টি চালান যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়েছে।

বিপরীতে রপ্তানি আয় দেশে আসেনি। রপ্তানি আয়ের রিপরীতে পাচারের অর্থকে সাধারণ ঋণে রূপান্তর করেছে এনআরবিসি ব্যাংক। এসব কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন সাফওয়ান জোবায়ের, মো. এনায়েতুল ইসলাম, আশরাফ মোহাম্মেদ আলী চৌধুরী, মোহাম্মেদ এনামুল কবির, মো. আশিকুল ইসলাম ও মো. আব্দুর রহিম মিয়া।

সরকারের পতনের পরে ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে তাকে দেশত্যাগে সহযোগিতা করেন আশরাফ মোহাম্মেদ। তিনি এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আদনান ইমামকে প্রদান করেন এবং কমিশনের ভাগ নিতেন। জেনেক্সের সাবেক সিএফও আব্দুর রহিম মিয়া হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করেন এবং কমিশনের আয়ে একাধিক বহুতল ভবনের মালিক হন।

এনআরবিসি ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান থাকাকালে পোশাক রপ্তানি করলেও আয়ের বিপরীতে সেই অর্থ দেশে ফেরত আসেনি। সেই অর্থে ইউকে ও দুবাইয়ে স্ত্রী নাদিয়া মোমিনের (যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ পাসপোর্টধারী) নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ কিনেছেন। এসব অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক, এনবিআরের আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা শাখা।

এমন ঋণে বিস্ময় প্রকাশ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘১০০ কোটি নয়, ১ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ হলেও গ্রহীতা জানবেন না এটা কী করে সম্ভব? বিষয়টি আমাদের বিশেষ টিম দেখছে। আপডেট জানানো হবে।’

এদিকে, অর্থ পাচারকারীদের সম্পর্কে সংবাদিকদের কাছে তথ্য সহযোগিতা চান এনবিআরের আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের কমিশনার মো. রাকিব।

তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘সাংবাদিকেরা আমাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারেন। এটি বাংলাদেশে নতুন একটি ইউনিট, যা দুর্নীতি ঠেকাতে নানামুখী কাজ করছে। চালুর পর স্বল্প সময়ে সফলতার হারও অনেক বেশি।’

জানতে চাইলে দুদকের পরিচালক আখতারুজ্জামান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘দুদকের অনুসন্ধানকাজ চলমান। দুদকের মামলায় অনেকের সম্পদ জব্দ ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। দেশ-বিদেশে অর্জিত অবৈধ সম্পদ দেশে ফেরাতে কাজ করছে সরকার।’

এনআরবিসি ব্যাংকে সদ্য যোগদানকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তৌহিদুল আলম খান আগে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডে কর্মরত ছিলেন। ঋণ সম্পর্কে কথা হলে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি এবং সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি। তবে আপনার দেওয়া উত্তরা শাখার ঋণপত্রটি দেখে আমি অবগত হলাম। গ্রাহক সবার ঊর্ধ্বে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

একই সঙ্গে এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলী হোসেন প্রধানীয়া ‘গ্রহীতার অজান্তে বাংকের ঋণ অনুমোদন’-এর কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেননি।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!