বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২৫, ০৬:৩৮ এএম

অনলাইনেই এখন ইয়াবা বিক্রি নিরাপদ!

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২৫, ০৬:৩৮ এএম

অনলাইনেই এখন ইয়াবা বিক্রি নিরাপদ!  ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

অনলাইনেই এখন ইয়াবা বিক্রি নিরাপদ! ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

সামাজিক যোগাযোগের নিরাপদ মাধ্যমকে ব্যবহার করছে দেশের মাদক কারবারিরা। খুচরা কেনাবেচা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এখন টেলিগ্রাম, সিগনাল, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ও থ্রিমার মতো এনক্রিপটেড অ্যাপ ব্যবহার করছে কারবারিরা।

প্রযুক্তি বিশ্লেষক ও গোয়েন্দারা বলছেন, ইয়াবা সেবনে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। তা ছাড়া ইয়াবা সরবরাহের কাজে আগে পুরুষেরা বেশি ব্যবহার হতো, এখন নারীদের ব্যবহার করছে মাদক কারবারিরা। তা ছাড়া অনেক উঠতি বয়সের নারীরা স্মার্টনেস ধরে রাখতে ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে।

এসব নিয়ে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুরক্ষিত এসব অ্যাপ নজরদারির মতো কোনো প্রযুক্তি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নেই। বিশ্বে এখনো তেমন কোনো প্রযুক্তি তৈরি হয়নি। এ কারণে অ্যাপে গ্রুপ খুলে মাদক কারবারে কারা জড়িত, সে বিষয়ে একপ্রকার অন্ধকারেই দেখছে মাদক নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এতে করে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে তারা।  সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনক্রিপটেড ম্যাসেজিং অ্যাপগুলো অত্যন্ত সুরক্ষিত। এতে সরাসরি কথোপকথনের সময় তথ্য বা ডেটা একটি সংকেতে বা কোডে রূপান্তর হয়ে আদান-প্রদান হয়। যারা তথ্য আদান-প্রদান করে শুধু তারাই বুঝতে পারে। মাঝখানে কেউ যদি প্রবেশ কওে, তাহলে হিজিবিজি লেখা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। কিছু বোঝার উপায় থাকে না।

গত ১৯ জুন রাজধানীর শ্যামপুর এলাকা থেকে পৃথক অভিযান পরিচালনা করে ২৫৫৬ পিস ইয়াবাসহ দুই নারী তামান্না আক্তার ও ফরিদা বেগমকে গ্রেপ্তারের পর ডিএমপির শ্যামপুর থানা পুলিশ জানায়, ধোলাইপাড় এলাকা থেকে তামান্নাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ধোলাইপাড় মোড়ের এক দোকানের সামনে থেকে ফরিদাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা সেবন ও বিক্রি করে আসছিল।

আমরা যাতে তাদের ধরতে না পারি এ জন্য অপরাধীরা হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে মাদক বিক্রি করতে থাকে। পরে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশের ভাষ্য মতে, তামান্না একটু মোটা হওয়ার সুবাদে নিজেকে চিকন করতে ২০১৪ সালে ইয়াবায় জড়িয়ে পড়ে। পরে তার স্বামীর সাথে ডিভোর্সও হয়।

একই দিন দিনাজপুর সদর উপজেলার মাশিমপুর এলাকায় ১ হাজার ৪০০ পিস ইয়াবাসহ শিউলি মনি নামের এক নারীকে আটক করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দিনাজপুর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. রাকিবুজ্জামান জানান, তাকে ধরতে একটু কষ্ট হয়, কারণ সে ইয়াবা ব্যবসায়ের কাজে ইমো ও টেলিগ্রাম ব্যবহার করত। মোবাইল নম্বর কম ব্যবহার করত। কাস্টমারদের বাসায় যোগাযোগ করে ইয়াবা বিক্রি করত এবং নিজেও সেবন করত।

তল্লাশির সময় তার বাড়ি থেকে ১ হাজার ৪০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়, যার আনুমানিক মূল্য ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তবে ধরার পর শিউলি মনি আমাদের জানিয়েছে, এক বান্ধবীর খপ্পরে পড়ে সে ইয়াবায় আসক্ত হয় এবং পরে ব্যবসায়ে জড়িয়ে পড়ে।

এদিকে গত শনিবার ঢাকার কদমতলীতে ৬০০ ইয়াবাসহ এক নারী মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) ওয়ারী বিভাগ। ওই নারীর নাম সুফিয়া (৫৬)। সুফিয়ার স্বামী মারা যাওয়ার পর নিজেকে স্মার্ট হিসেবে তৈরি করতে চান। তার কারণ ছিল তিনি ৩৫ বছরের এক যুবককে পছন্দ করতেন। তিনি একটু মোটা হওয়ায় ওই যুবক তাকে ইয়াবা খেতে উৎসাহিত করেন।

এরপর দুজনে মিলে ইয়াবা সেবন করেন। একসময় তারা খাওয়ার পাশাপাশি মোটা টাকা রোজগারের জন্য নিজেরাই ব্যবসায়ে জড়িয়ে পড়েন।

এ বিষয়ে ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, ডিবি ওয়ারী বিভাগের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক নিয়ন্ত্রণ টিম গোপন সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারে, একজন মাদক কারবারি ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রির জন্য জুরাইনের বিক্রমপুর প্লাজার সামনে অবস্থান করছেন। এমন তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালায় ডিবি পুলিশের টিম। ডিবি পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর সময় নারী মাদক কারবারি সুফিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিসি তালেবুর রহমান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়- সুফিয়া একজন পেশাদার মাদক কারবারি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ইয়াবা সেবন ও ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত।

পুলিশ সদর দপ্তর, র‌্যাব সদর দপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের গত ৬ মাসে দুই শতাধিক নারীকে ইয়াবা সরবরাহকালে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগ মাদক সেবনকারী ও ব্যবসায়ী।

অনলাইনের মাধ্যমে ইয়াবা ক্রয়-বিক্রয়

রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অবাধে মিলছে প্রায় সব ধরনের মাদক। একসময় স্পটভিত্তিক মাদক বিক্রি হলেও এখন ছড়িয়ে গেছে সবখানে। পুলিশের তথ্য বলছে, ইয়াবা ছোট হওয়ায় এটি বহনে বেশ আরামদায়ক মনে করে। এ জন্য তারা ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্যান্য সামাজিক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনের মাধ্যমে ইয়াবা ক্রয়-বিক্রয় করছে মাদক কারবারিরা। ঘরে বসে অর্ডার করলেই পৌঁছে যাচ্ছে পছন্দের মাদক। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, বর্তমানে স্মার্টনেস ধরে রাখার জন্য নারীরাই বেশি ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে।

কিছুতেই থামছে না ইয়াবা সেবন

মাদক বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলা ও মাদকের অপব্যবহারবিরোধী অভিযান চলমান থাকলেও কিছুতেই থামছে না ইয়াবা সেবন।  আইনে আছে, মাদক বিক্রি করা বা এ কাজে সহযোগিতা দণ্ডনীয় অপরাধ। অনেকে শাস্তি পাচ্ছেন এ মামলায়, অনেকেই বিচারাধীন। এরপরও মাদকের চাহিদা বেড়েই চলেছে বলে মনে করে সচেতন মহল।

এসব নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহল বলছেন, বাংলাদেশে এখন পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবার মতো ভয়াবহ মাদক। এটি সেবনকারীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় মাদক। এই মাদকে বেশির ভাগ উঠতি বয়সি যুবক-যুবতীরা আসক্ত।

রামপুরায় কথা হয় সুমি নামের এক মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীর সাথে। তিনি বলেন, ঢাকায় এখন ইয়াবা সর্বত্রই, বিশেষ করে এটির ডিলার আমরা যারা ছোট ডিলার আছি। তাদের কাস্টমাররা ফোন করলেই গন্তব্যে দিয়ে আসি। টাকা বাড়িয়ে দেয়। পুলিশের তেমন কোনো ঝামেলা থাকে না।

তিনি বলেন, আমি যাদের চিনি এবং আমার যারা পরিচিত তারা যখন ইয়াবা চায়, তখন তাদের এটি দিয়ে আসি।

ডিএমপির একটি সূত্র মতে, ২০২৪ সালে ডিএমপির মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় ১৭ হাজারের ও বেশি মাদক কারবারি ও সেবনকারীকে। এর মধ্যে ইয়াবার মামলা বেশি এবং নারীর সংখ্যাও বেশি। ডিএমপি বলছে, এসব ঘটনায় বেশির ভাগ যুবতী নারী ও মহিলারা জড়িত আছে। ডিএমপির তথ্য বলছে, শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন মাদক মামলা হয় শতাধিক।

এদিকে কারাগার সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে কারাগারে অন্য অপরাধীর চেয়ে মাদক সেবন ও কারবারির সংখ্যা বেশি। ওই সূত্রটি জানায়, কারাগারে প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ কয়েদিই মাদক মামলার আসামি।

ডিএমপির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, সারা দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ লাখেরও বেশি।  তিনি বলেন, কিন্তু সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ৭ হাজারের মতো।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, শুধু ইয়াবা নয়, প্রতিটা মাদক কারবারি কৌশল পাল্টাচ্ছে। তবে এখন ইয়াবা সেবনের চাহিদা বাড়ছে বললে ভুল হবে না। এটি ছোট হওয়ায় অপরাধীরা প্রযুক্তির সুযোগ নিচ্ছে। এসব কারণে তাদের ধরতে অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে গোয়েন্দাদের। তবে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে বেশির ভাগই যুবক-যুবতী।

তিনি বলেন, মাদক কারবারিরা একে অন্যকে বিশ্বাস করে না। তারা এনক্রিপটেড ম্যাসেজিং অ্যাপে নিজেদের মধ্যে যেসব বার্তা আদান-প্রদান করে, সেগুলো মুছে দিচ্ছে। তাই কোনো মাদক কারবারি গ্রেপ্তার হলেও অন্যদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। যে সিম ব্যবহার করে অ্যাপ খোলা হয়, সেটাও ফেলে দেয়। যে নামে ওই সিম তোলা হয়, তা-ও ভুয়া।

এ বিষয়ে প্রযুক্তি বিশ্লেষক ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের এক অতিরিক্ত উপকমিশনার জানান, মাদক কারবারিদের অ্যাপে কোনো তথ্য থাকে না। তা ছাড়া ইয়াবা বা মাদক সেবনকারীরা যে মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে, সেটাও তাদের নামে থাকে না। যে কারণে ফোন নম্বর হলেও আসল অপরাধীদের ধরা সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে যে বিপ্লব হয়েছে, সেই বিপ্লবে বিপরীত ভূমিকার কারণে পুলিশের মনোবল ভেঙে গেছে এবং তাদের নৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা।

সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করছি, আগে ইয়াবা ক্রয়-বিক্রয় কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বর্তমান সেটা নেই বললেই চলে। অনেকেই এটি নিয়ন্ত্রণে সামাজিকভাবে ভূমিকা রাখতে ভয় পাচ্ছে। তা ছাড়া ইদানীং নারীরা ইয়াবা সেবন ও বিক্রির কাজে বেশি যুক্ত হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

এদের শুধু গ্রেপ্তারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সামাজিকভাবে কাউন্সেলিং করে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিতে হবে। তা ছাড়া ইয়াবার ভয়াবহতা তুলে ধরতে হবে এবং সেবন করলে কী কী ক্ষতি হয়, সেটাও সামাজিকভাবে তুলে ধরলে এসব অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!