র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দেশে গুম করে ভারতে হস্তান্তর করত। অনেক সময় ভারতের হেফাজত থেকেও বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা হতো বলে একাধিক ভুক্তভোগী গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, গোপন বন্দিশালায় তাদের সঙ্গে এমন ব্যক্তিরাও দেখা করতেন, যারা কথা বলতেন হিন্দিসহ বিদেশি ভাষায়। তাদের কখনো জমটুপি পরিয়ে হস্তান্তর করা হতো ভারতে। আবার চোখ বেঁধে মোটরসাইকেলে করে বর্ডার ক্রস করে পাঠানো হতো ওপারে। গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন বিশ্লেষণ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ : আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি জমা দেয় কমিশন।
কমিশন জানায়, ক্ষমতায় থাকাকালীন আওয়ামী লীগ একদিকে যেমন নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি অন্যদিকে একটি রাজনৈতিক বয়ান গড়ে তোলে, যেখানে দলটি নিজেকে বাংলাদেশে ইসলামপন্থি চরমপন্থার উত্থানের বিরুদ্ধে একমাত্র কার্যকর প্রতিরক্ষাকবচ হিসেবে উপস্থাপন করে। আওয়ামী লীগ এই বয়ান আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিসর, জনসম্মুখে ভাষণ এবং দলীয় প্রচারে ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করেছে। আওয়ামী লীগের দেশীয় সন্ত্রাসবিরোধী বয়ানটি ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে কমিশন।
জানা গেছে, ২১ বছর বয়সি এক যুবক ভুক্তভোগী ডিজিএফআই, র্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১ কর্তৃক ২ বছর ৮ মাস ৭ দিন নিখোঁজ ছিলেন। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ব্যক্তি প্রথমে ভারতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে আটক হন।
এরপর ডিজিএফআই একটি প্রশ্নপত্র পাঠায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে, যা তারা আটক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করে এবং তার উত্তরগুলো আবার বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ডিজিএফআইয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকেও গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনকে নিশ্চিত করা হয়েছে। পরে ওই ব্যক্তিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ডিজিএফআইয়ের হেফাজতে নেওয়া হয়। যেখানে তাকে বছরের পর বছর ধরে গুম করে রাখা হয়।
ওই ভুক্তভোগী ব্যক্তি কমিশনের কাছে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে হস্তান্তরের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাতের বেলা, রাত দেড়টার দিকে, ইন্ডিয়ান অফিসাররা প্রথমে আমার চোখ বাঁধল। হ্যান্ডকাফ তো আছেই। ওরা অস্ত্রসহ রেডি হলো। তারপর গাড়ি থেকে ১০ মিনিট পরে নামাল। নামানোর পরে বুঝলাম, আমাকে হস্তান্তর করতেছে আর কি। আমাকে বলছে, ‘তুমি বসো, তুই বস।’ আমাকে বসিয়ে, নিচ দিয়ে পার করছে।
আরেক পুরুষ ভুক্তভোগী, তার বয়সও ২১ বছর। তাকে ২০২৩ সালে র্যাব-৪ ও র্যাবের গোয়েন্দা শাখা কর্তৃক গুম করা হয়। ওই ভুক্তভোগী ১ বছর ৩ মাস ২৪ দিন নিখোঁজ ছিলেন। তিনি র্যাবের গোয়েন্দা শাখা পরিচালিত দুটি কেন্দ্রে বন্দি অবস্থায় ছিলেন। তাকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে হস্তান্তর করা হয়, সেখানে পরে তাকে ভারতীয় মুসলমানদের নিয়ে ভিডিও কনটেন্ট পোস্ট করার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এ ভুক্তভোগী গুম কমিশনকে বলেন, ওরা ওই জায়গায় তিন মাস রাখল। রাখার পর একদিন ওরা আবার আমাকে প্রথম যে জায়গায় রেখেছিল, সেই জায়গায় নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে বলল, ‘বড় বড় অনেক গোয়েন্দা সংস্থা আছে, আমাদের হাত থেকে নিয়ে তোকে মাইরা ফেলবে। আমাদের কাছে এত দিন ছিলি, তোর ভালোর জন্য তোকে দেশের বাইরে কিছুদিন রাখতে চাই।’
পরে তারা বলল, ‘তোমার আম্মা অনেক কান্নাকাটি করতাছে। এর জন্য অনেক ছড়াছড়ি হয়েছে। তাই তোমাকে দেশে রাখা যাবে না, দেশের বাইরে পাঠাব আমরা।’ ‘তোমাকে আমরা ইন্ডিয়া পাঠাব।’ ‘তার পরের দিনই আমাকে রেডি করে নিয়ে গেল। হাইয়েস গাড়িতে করে নিয়ে গেছিল, চোখ বেঁধে।
বর্ডারে দুইটা লোক আইছিল, হোন্ডায় করে।’ বলল, ‘এরা তোরে পার করে দিব। তার পরে তুই ওই জায়গায় কত দিন থাকবি, আবার আমরা তোকে ব্যাক নিয়ে আসব।’ ‘যখন আমাকে অন্যজনের কাছে তুইলা দিল, তখন আমার চোখ খোলা। তখন যারা আমাকে নিয়ে গেছে, তাদের দেখছি। তারপর একটা নদী পার করাইল। ওই নদী পার করার পর কাঁটাতারের একটা বেড়া ছিল। ওই বেড়া দিয়ে আমাকে পার করে তারা নিয়ে গেল।’
ভুক্তভোগী আরও বলেন, “ওরা বইলা দিছিল, ‘এই বাস যেই জায়গায় থামবে, ওই জায়গায় তুই নেমে পড়বি। ওই জায়গায় লোক আইবো, তারা তোকে নিয়ে যাবে। লোক আইবো, তারা তোকে কাজ-কাম দিয়া দিবে। কিছুদিন থাকবি।’ ‘পরে আমি নামার পর দেখি, কেউই আসে না। রাত হয়ে যায়। আমাকে র্যাব তিন হাজার বাংলাদেশি টাকা দিছিল। ইন্ডিয়া আসার পর, ওই ৩০০০ টাকা নিয়ে যায়। পরে আমাকে ইন্ডিয়ান ১০০০ টাকা দেওয়া হয়। আমি ভাবলাম দেখি, কোনো শোয়ার জায়গা আছে কি না।
পরে হাঁটতে থাকলাম। রাস্তায় ছিলাম প্রায় চার দিন। খাবার-দাবারের কিছু ছিল না। ওই যে টাকা দিছিল, শুধু পানি কিনে খাইতাম। মানে পানি খেয়ে বাঁচতাম; খাবার কিনতাম না। কিনলেই তো টাকা ফুরায় যায়। চার দিন আমি বাসস্ট্যান্ডে শুয়ে আছিলাম। পরে এলাকার লোকজন আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।”
তিনি জানান, “থানায় নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করল। আমি কিসের জন্য আইছি? পরে আমি সব কিছু খুলে বললাম, ‘আমাকে র্যাব ধরছে। তারা আমাকে এই জায়গায় পাঠাইছে। আর আমাকে জঙ্গি বলে ধরছিল।’ তারা এগুলা বিশ্বাস করে না। তারা আমাকে ‘আনপাসপোর্ট কেস’ দেয়।
আনপাসপোর্ট কেস দিয়ে আমাকে জেলে দেয়। দুইটা টয়লেটের মাঝখানে মানে টয়লেটের যেটা নোংরা, ওইগুলার মাঝখানে আমাকে শোয়াইত। আবার দোতালার পাইপের ওপর, ভাঙ্গা টয়লেটে, ওই জায়গা থেকে ছিটা-ছুটা আইত শরীরের ওপর। ওই জায়গায় শোয়াইত। আবার খাবার কখনো দিত, কখনো দিত না। কাজ করাইত, কাজ কইরা দেখতাম খাবার নাই।”
কমিশনের এক প্রশ্নের উত্তরে ভুক্তভোগী বলেন, “হ্যাঁ, দিল্লি থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লোক আইছে। তারা বলল, ‘আমরা দিল্লি হেডকোয়ার্টার থেকে আইছি।’ তারা আইসা জিজ্ঞাসাবাদ করছে, ‘তুই কিসের জন্য ইন্ডিয়াবিরোধী ভিডিও ছাড়ছিস?’ আমি বললাম, ‘আমি জানি না, আর আমি কিছু ছাড়ি নাই।’ তারা বাংলা বলছে। ভারতবিরোধী ভিডিও কিসের জন্য পোস্ট করতাছি, বিশেষ করে কাশ্মীরবিরোধী ভিডিও।
মানে মুসলমানদের একটু জুলুম হইতেছে না, ওইটার পক্ষে কিছু বলা হইছে। তারা জিজ্ঞাসা করছে ইন্ডিয়ার প্রসঙ্গে। তারা বলল, ‘এই ভুল জানি আর জীবনে করবা না। এইবারের মতো ছেড়ে দিলাম।’ তারা টর্চার করে নাই, তবে কাজ করাইত কিন্তু খাইবার দেয় নাই।”
অপর এক ত্রিশ বছর বয়সি পুরুষ ভুক্তভোগী। যিনি জঙ্গি তকমায় র্যাবের গোয়েন্দা শাখা কর্তৃক ১০ মাস নিখোঁজ ছিলেন। তাকেও দেশে বন্দি করে ভারতে হস্তান্তর করা হয়েছিল। যা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য ও ভারতীয় মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে সত্যতা পেয়েছে কমিশন।
এ ভুক্তভোগী গুম কমিশনকে বলেন, “যখন আমি হাঙ্গার স্ট্রাইক দিলাম, তখন গুমখানায় ডিউটি করা অফিসার পর্যায়ের একজন কয়, ‘তুমি নিজেকে নিজে মাইরা ফেলাইতেছ কেন? তুমি জানো নেলসন ম্যান্ডেলা কত বছর জেল খাটছে?’ ‘ইউসুফ নবী অনেক জেল খাটছে, শাস্তি খাটছে’, এগুলো তারাই বুঝাইত।”
“আমি বড় স্যারদের সাথে কথা বলতে চাই। পরে একজন বড় স্যারÑ উনি আমাকে সর্বপ্রথম জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন এবং সর্বশেষও উনি জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেনÑ তার মনে একটু কিঞ্চিৎ ১% হয়তো মানুষের ছোঁয়া আছে। সবাই প্রচণ্ড খারাপ লোক, কোনো সন্দেহ নাই। তো আমি বলতেছি, ‘স্যার, আমারে আর কষ্ট দিয়েন না। আমারে স্যার ক্রসফায়ার দেন। আমারে শুধু শুধুই রাখছেন।’
তো পরে বলে, ‘না, বাইচে থাকতে হবে।’ তারা সবচেয়ে বেশি ফোকাস করতেছিল, ‘তুমি কয়টা নাম বলে চলে যাও। নাম বলো।’ আমি বলছিলাম, ‘নাম জানি না... জঙ্গিসংশ্লিষ্ট... আমি নাম জানবো কেমনে?’ বড় স্যারে আমারে বললেন, ‘ঠিক আছে, যাও, এক সপ্তাহের মধ্যে একটা ব্যবস্থা হবে।’ এই ব্যবস্থা করছিল ঠিকই, কিন্তু মাগার আমারে ইন্ডিয়া চালান করে দিল। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হইছে তারা আমারে ইন্ডিয়া চালান করল।”
ইন্ডিয়া চালানের বর্ণনায় ভুক্তভোগী কমিশনকে বলেন, “গাড়িতে উঠাইয়া আমাকে জমটুপি পরিয়ে ফেলে, যেটাতে আপনি স্বাভাবিকভাবে বাতাস নিতে পারবেন না। গাড়ি থেকে নামাইল... রাত দুইটার মতো বাজে আনুমানিক। তো এখান থেকে নামাইয়া অনেক দূর রাস্তা হাঁটায়। দুজন লোকের ওপর আমি ভর দিই... পরে দুজন লোকের কাছে হস্তান্তর করল। তারা একটু সামান্য হাঁটায়া অন্য একটা গাড়িতে তোলে আমাকে থানাতে দিল। বিভিন্ন মাধ্যমে আমি জানার চেষ্টা করলাম, কারা আমাকে দিয়া গেছে এখানে। বলতেছে, ‘তোরে দিয়া গেছে এসটিএফ-এর লোকেরা।’ স্পেশাল টাস্কফোর্স, পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা সংস্থা।”
ওই ভুক্তভোগী কমিশনকে জানান, “তাকে আনপাসপোর্ট মামলা দেওয়া হয়েছিল। জেল খাটা হলে গাড়ির সিরিয়াল পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হইল জেলখানাতে। এটাকে আরপি সিরিয়াল বলে। আরপি মিনস হচ্ছে ‘রিলিজ প্রিজনার’ মানে যেসব প্রিজনারের সাজা খাটা শেষ।
অনেক লোক আছে, যাদের গাড়ির সিরিয়াল পেতে তিন মাস পর্যন্ত সময় লেগেছে। তখনকার জেল সুপারটা ভালো ছিল বিধায় আমারটা ২৯ দিনে পাওয়া যায়।”
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোপন বন্দিশালায় বন্দিদের সঙ্গে এমন ব্যক্তিরাও দেখা করতেন, যারা হিন্দিসহ অন্যান্য বিদেশি ভাষায় কথা বলতেন। একাধিক বন্দির কাছ থেকে এ তথ্য পেয়েছে কমিশন।
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বিবরণগুলো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক, অস্বচ্ছ এবং দ্বিপক্ষীয় গোয়েন্দা সহযোগিতার ধারাবাহিকতাকে ইঙ্গিত করে, যার মধ্যে সীমান্ত পারাপার এবং বন্দিদের যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওপরের তথ্যগুলো থেকে ধারণা পাওয়া যায়, এই সহযোগিতা সব সময় যেকোনো ব্যতিক্রমধর্মী নিরাপত্তা হুমকির প্রতিক্রিয়ায় পরিচালিত হয়েছে তা না; অনেক ক্ষেত্রেই তা ছিল অবাক রকমের তুচ্ছ কারণ দ্বারা প্ররোচিত।
সুব্রত বাইনকে ঘিরে বন্দি বিনিময়ের আলোচনা আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরে যে এ ধরনের কার্যক্রম কতটা ঘন ঘন হতো এবং কীভাবে তা এক ধরনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়ে উঠেছিল, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
আপনার মতামত লিখুন :