চলতি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের বিনা মূল্যের ১ কোটি ৫৫ লাখ পাঠ্যবই অতিরিক্ত ছাপিয়ে প্রায় ৭৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা (প্রতিটি বইয়ের মূল্য গড়ে ৫০ টাকা ধরে) লুটপাট করেছে একটি সিন্ডিকেট। অতিরিক্ত চাহিদার এসব বইয়ের মধ্যে প্রাথমিক স্তরের রয়েছে ৫৫ লাখ ও মাধ্যমিক স্তরের রয়েছে ১ কোটি বই।
শিক্ষার্থীর বিপরীতে বইয়ের চাহিদা নির্ধারণে উপজেলার মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা, প্রেস ও পরিবহন এজেন্সি তিনটি গ্রুপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট এই লুটপাটে জড়িত বলে এনসিটিবির এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে।
চলতি শিক্ষাবর্ষের বই ছাপানোর কাজের প্রায় শেষদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া এনসিটিবির প্রতিবেদনেও অতিরিক্ত চাহিদা দেখিয়ে কাজ নেওয়ার কৌশল ও সিন্ডিকেটের সংশ্লিষ্টতা তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি আগামী দিনে অতিরিক্ত চাহিদার বই ছাপানো ঠেকাতে কী করা যায়- সে সুপারিশও করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রেসগুলো সিন্ডিকেট করে কীভাবে দরপত্র দেয়, বই ছাপাকে কেন্দ্র করে কাগজ মিল মালিক ও ডিলারদের ভূমিকা, বাইন্ডিং সমস্যাসহ সার্বিকভাবে বই ছাপার পুরো বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও শিক্ষা প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক (প্রাথমিক) প্রফেসর মুহাম্মদ আবু নাছের টুকু।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, বিনা মূল্যের বই বিতরণের শুরু থেকেই উপজেলা পর্যায়ে অতিরিক্ত চাহিদা দিয়ে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার এ সিন্ডিকেটের বিষয়ে এনসিটিবিসহ সংশ্লিষ্টদের কমবেশি ধারণা ছিল। চলতি বছর শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাঠপর্যায় থেকে আসা বইয়ের চাহিদা দেখে সন্দেহ হয় এনসিটিবির। অতিরিক্ত বই ছাপা ঠেকাতে তখন নানা পদক্ষেপও নেওয়া হয়। এতে অতিরিক্ত চাহিদার প্রায় এক কোটি বই কম ছাপা সম্ভব হয়। ফলে সরকারের সাশ্রয় হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকা। তবুও শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপানো মোট বইয়ের মধ্যে ১ কোটি ৫৫ লাখ অতিরিক্ত চাহিদার বলে মনে করছে এনসিটিবি। এনসিটিবির প্রতিবেদনে অতিরিক্ত চাহিদা দিয়ে বই হাতিয়ে নেওয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত প্রধান অঞ্চলগুলো হলো সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কক্সবাজার।
আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ। এনসিটিবি সূত্রের দাবি, আগামী শিক্ষাবর্ষে আর অতিরিক্ত চাহিদা দিয়ে বই নেওয়ার সুযোগ পাবে না সিন্ডিকেট। এতে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয়ের ৭৭ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানিয়েছে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ। তবে প্রতিবেদনটি প্রস্তুতকারী প্রফেসর মুহাম্মদ আবু নাছের টুকু বলেছেন, আগামী শিক্ষাবর্ষে যাতে অতিরিক্ত চাহিদার বই না যায়, সেজন্য মাঠপর্যায় থেকে যে চাহিদা পাওয়া গেছে তা কঠোরভাবে যাচাই করা হয়েছে। জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে বই সংগ্রহে জড়িত উপজেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত চাহিদার বই নেওয়া ঠেকাতে এনসিটিবির প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নে মনিটরিং করা হচ্ছে।
জানা গেছে, আগামী ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপানোর আগামী সপ্তাহে শুরু হতে যাচ্ছে। মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার দরপত্র বাতিল করে পুনঃদরপত্র (রিটেন্ডার) আহ্বান করা হয়েছে। আর ইবতেদায়ি ও নবম-দশম শ্রেণির বই ছাপার দরপত্র মূল্যায়ন চলছে। এরপর ক্রয় কমিটির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ৩০ কোটির বেশি বই ছাপার কাজ করছে এনসিটিবি। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের জন্য ৮ কোটি ৪৯ লাখ ২৫ হাজার এবং মাধ্যমিক স্তরে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ২১ কোটি ৪০ লাখসহ মোট ৩০ কোটি বই রয়েছে। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ৪০ কোটি বই ছাপানো হয়েছিল, কিন্তু ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে ১০ম শ্রেণির জন্য ৫ কোটি ও অতিরিক্ত বিষয়ের জন্য আরও ৫ কোটি বই ছাপানো হচ্ছে না বলে জানা গেছে। এই ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যেই অতিরিক্ত চাহিদার ১ কোটি ৫৫ লাখ বই ছিল।
বই নিয়ে কারসাজি
এনসিটিবির বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বই ছাপা কার্যক্রমের প্রথম ধাপ হচ্ছে শিক্ষার্থীর বিপরীতে বইয়ের সংখ্যা নির্ধারণ করা। বইয়ের সংখ্যা নির্ধারণের কাজটি এনসিটিবি সরাসরি করে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) তাদের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মাঠপর্যায় থেকে বইয়ের সংখ্যা সংগ্রহ করে এনসিটিবিকে সরবরাহ করে থাকে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা, প্রেস ও পরিবহন এজেন্সি এই তিনটি গ্রুপের সিন্ডিকেট বেশকিছু পদ্ধতিতে অতিরিক্ত বই নিয়ে বাণিজ্য করছে বলে এনসিটিবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে সিন্ডিকেটের কারসাজির বিবরণের বলা হয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কতিপয় দুর্নীতিবাজ উপজেলা শিক্ষা অফিসার প্রকৃত চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত চাহিদা দিয়ে থাকেন। মাধ্যমিক পর্যায়ে এই হার তুলনামূলক বেশি। এই কর্মকর্তাদের সঙ্গে রয়েছে কিছু প্রেস। এসব প্রেস অতিরিক্ত চাহিদার বই না ছাপিয়ে প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী বই ছাপিয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলায় প্রেরণ করে। তবে প্রেসগুলো উপজেলায় প্রেরিত চালানে মোট বইয়ের (অতিরিক্তসহ) সংখ্যা হিসেবে স্বাক্ষর নেয়। পরে অতিরিক্ত বইয়ের মূল্য দুই পক্ষ ভাগ করে নেয়। কিছু প্রেসের মতো কতিপয় পরিবহন এজেন্সির সঙ্গেও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের যোগাযোগ থাকে।
অনেক ক্ষেত্রে প্রেস অতিরিক্ত চাহিদাসহও বই সরবরাহ করে থাকে। পরিবহন এজেন্সির প্রতিনিধি উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে প্রকৃত চাহিদার অতিরিক্ত বই সংগ্রহ করে সিন্ডিকেটে জড়িত প্রেসের কাছে বিক্রয় করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রেসগুলোয় বান্ডিলে কম বই দেয়। উপজেলা শিক্ষা অফিসারের প্রতিনিধি বান্ডিল গুনে বই বুঝে নেয়। কিন্তু বান্ডিলের ভেতরের বইয়ের সংখ্যার সঙ্গে বান্ডিলের উপরে লেখা বইয়ের সংখ্যা মিলিয়ে দেখে না। এভাবেও হাতিয়ে নেওয়া অতিরিক্ত বই।
অনেক ক্ষেত্রে প্রেসগুলো উপজেলা শিক্ষা অফিসে কম বই দিয়ে চালান স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে বকেয়া বইগুলো পরবর্তীতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও সরবরাহ করে না। কিছু ক্ষেত্রে সরবরাহ করতে বাধ্য হলেও বই না ছাপিয়ে ‘কার্ব মার্কেট’ (অন্য প্রেসের ছাপানো অতিরিক্ত বই) থেকে সংগ্রহ করে। এতে ছাপানোর তুলনায় খরচ কম পড়ে।
এনসিটিবির বিশেষ প্রতিবেদনে অতিরিক্ত বই হাতানোর বিষয়ে আরও বলা হয়েছে, অনেক প্রেস খারাপ বই প্রিন্ট করে নিজস্ব অন্য গুদামে সংরক্ষণ করে। উপজেলায় বই পাঠানোর সময় মূল প্রেসের নামে বই পিডিআই (প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন) করায় আর উপজেলায় ডেলিভারির সময় অন্য গুদামের রাখা খারাপ বই বা আংশিক খারাপ বই মিলিয়ে গন্তব্যস্থলে পাঠায়। আবার ছোট ছোট প্রেসগুলো বড় প্রেস থেকে বই সংগ্রহ করে পিডিআইর সময় ইন্সপেকশন এজেন্টকে ম্যানেজ করে সেসব বই নিজেদের দেখায়।
কতিপয় বড় প্রেস সারা বছর নিয়মিত বেতনভুক্ত কর্মী রাখে। এই কর্মীদের মূল কাজ সংশ্লিষ্ট উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও পরিবহন এজেন্ট প্রতিনিধিদের সঙ্গে সখ্য বজায় রাখা। বই ছাপার মৌসুমে এসব কর্মীরা কার্ব মার্কেট থেকে অতিরিক্ত চাহিদার বই সংগ্রহ করে তাদের প্রেসকে সহযোগিতা করে। সিন্ডিকেটে জড়িত প্রেসগুলো তাদের পাওয়া কাজের মধ্যে কিছু বই কার্ব মার্কেট থেকে সংগ্রহ করতে পারবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে অবশিষ্ট বই ছাপা শুরু করে। কার্ব মাকেট থেকে বই কিনলে ছাপার তুলনায় প্রেসগুলোর খরচ কম পড়ে।
এ ছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক প্রেস তাদের পাওয়া কাজ ‘লট’ (যেমন তৃতীয় শ্রেণির একটি লটে বই রয়েছে ৪ লাখ) হিসেবেই করে থাকে। কিন্তু পিডিআই ইন্সপেকশনের সময় প্রেসগুলো বিভিন্ন লটের (যেমন- প্রথম শ্রেণির ১ লাখ, দ্বিতীয় ২ লাখ ও তৃতীয় ১ লাখ) বই ছাপা হচ্ছে বলে হিসেবে দেয়। এতে কোন বই কতটুকু ছাপা হচ্ছে সেই চিত্র বোঝা সম্ভব হয় না। নির্দিষ্ট সময়ে বই পাওয়া নিয়ে সংকট সৃষ্টির পেছনে এটাও বড় কারণ।
জানা গেছে, ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের সংখ্যা চার কোটি ৪৩ লাখ ২১ হাজার ৯০৬, সপ্তম শ্রেণির চার কোটি ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ৬৯২ এবং অষ্টম শ্রেণির চার কোটি দুই লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৮। মাধ্যমিকের মোট ২৮০টি লটের মধ্যে ১১ কোটি ৮৯ লাখ বই ছাপানোর দরপত্র বাতিল হয়েছে। যার মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬০৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের মোট পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে ৮ কোটি ৪৯ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপা শুরু করতে ঠিকাদারদের (ছাপাখানা মালিক) ‘সিডি’ সরবরাহ করা হয়েছে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের ‘পান্ডুলিপি’ প্রণয়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। চলতি মাসের মাঝামাঝি নাগাদ এই দুই শ্রেণির বইয়ের ‘সিডি’ কার্যাদেশ পাওয়া ছাপাখানাগুলোকে সরবরাহ করা চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আর প্রাক-প্রাথমিকের বইয়ের ‘সিডি’ সরবরাহ কার্যক্রমও দ্রুত শুরু হচ্ছে।
সুপারিশ
অতিরিক্ত চাহিদা দিয়ে বই নেওয়া বন্ধ করতে এনসিটিবির প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে প্রথমে রয়েছে বইয়ের চাহিদা সংগ্রহে শিক্ষা মন্ত্রণালয়/ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিশেষ সফটওয়ার তৈরি করা। চাহিদার সঠিক সংখ্যা নির্ধারণে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া। বইয়ের কাজ তদারকির জন্য ইন্সপেকশন এজেন্ট ও মনিটরিং কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা ও পেশাদারিত্বের ওপর গুরুত্ব দেওয়া। ইন্সপেকশন এজেন্টদের প্রেসগুলোর সন্দেহজনক গুদাম পরিদর্শনের অনুমতি দেওয়া। বইয়ের সংখ্যা অক্ষুণ রেখে লটের পুনর্বিন্যাস করা। ইন্সপেকশন এজেন্টদের লটভিত্তিক পিডিআই করা ও মনিটরিং কর্মকর্তাদের লটভিত্তিক চালানে স্বাক্ষর করা।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন