- প্রতারণার শিকার বিশ^বিদ্যালয়ের চার শিক্ষক
- টাকা নিয়ে জমি বুঝিয়ে না দেওয়ার অভিযোগ, কারো কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে দুবার
- ফ্ল্যাট দেওয়ার নামে টাকা নিয়ে তা ফেরত দেওয়া হয়েছে কয়েক ভাগে
- প্রতারণা ও অভিযোগ অস্বীকার অভিযুক্তদের
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াতপন্থি দুই অধ্যাপক এবং দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জমি কিনে ফ্ল্যাট ব্যবসায় প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের সঙ্গে ফ্ল্যাটবিষয়ক চুক্তি করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন এমন চারজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। কারো কাছ থেকে টাকা নিয়ে জমি বুঝিয়ে দেননি; কারো কাছ থেকে জমির টাকা নেওয়া হয়েছে দুবার, আবার কারো থেকে ফ্ল্যাট দেওয়ার নামে টাকা নিয়ে তা ফেরত দিয়েছেন কয়েক ভাগে।
এমন প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষক-কর্মকর্তারা হলেনÑ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান সরকার, আরবি বিভাগের অধ্যাপক জাহিদুল ইসলাম, ডেপুটি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মমিনুল ইসলাম ও হিসাব শাখার ডেপুটি ডিরেক্টর (হিসাব) কাজী মামুন রানা। তাদের মধ্যে সব ঘটনায় অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ভুক্তভোগী শিক্ষকরা হলেন, জুলাই-৩৬ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক লাভলী নাহার, ফোকলোর বিভাগের দুই শিক্ষক এবং অবসরপ্রাপ্ত একজন অধ্যাপক।
জানা যায়, অধ্যাপক লাভলী নাহারের কাছ থেকে প্রথমে জমি দেওয়ার আশ্বাসে ২০১৬ সালে ৫ লাখ টাকা নেন অভিযুক্তরা। পরে সেই জমি বাবদ ২০১৮ সালে আরও ২ লাখ টাকা নেন। দুই ধাপে টাকা নিলেও তারা জমি বুঝিয়ে দেননি। এতে ভুক্তভোগী শিক্ষক চাপ সৃষ্টি করলে জুন মাসে একটি সভা করেন তারা। ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি’র প্যাডে করা সভার রেজুলেশনে দেখা যায়, ইউনিসিটি ১১ কাঠা প্রজেক্টের ৭(এ) মনিরুজ্জামানের ফ্ল্যাটটি অধ্যাপক লাভলী ক্রয় করবেন। যার জমির দর ১২ লাখ টাকা ধরা হয়। এর মধ্যে ৭ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। পরে জমির দামের আরও ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেন তিনি। অধ্যাপক লাভলী মনিরুজ্জামানের ফ্ল্যাট ক্রয় করলেও তাকে জমি দলিল করে দেন জাহিদুল ইসলাম এবং মমিনুল ইসলাম। ফলে কাজ শেষ হতে প্রজেক্ট কমিটি খরচের হিসেবে অধ্যাপক লাভলী থেকে জমির মূল্য বাবদ সাড়ে ৭ লাখ টাকা কেটে নেন। এতে অধ্যাপক লাভলীকে বলা হয় আগের ১২ লাখ টাকার দায় প্রজেক্টের না। এতে একই জমির মূল্য তার থেকে দুবার নেওয়া হয়।
বিষয়টি সমাধানে অধ্যাপক লাভলী একাধিকবার পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও সমাধান পাননি। গত ১৭ আগস্ট তার স্বামী আবু সাইদ উপাচার্য বরাবর একটি অভিযোগ করেন। অভিযোগের একটি কপি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমার স্ত্রীকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অভিযুক্তরা জামায়াতে ইসলামীর রোকন পরিচয়ে একটি প্রজেক্ট থেকে ভিন্ন ভিন্ন খাতে টাকা আদায় করে। যার হিসাব জালিয়াতির ফ্রেমে বাঁধা। প্রজেক্টের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে মিটিং করে আমাকে মাস্তান দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করে ও প্রজেক্টের প্রথম ধাপের প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার অডিট হিসাব ও গত বছরের ১৬ আগস্টের সাধারণ সভার রেজুলেশন কপিও দিচ্ছে না। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পরিচয় দিয়ে মনিরুজ্জামান সরকার গংরা ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে আমাদের ১২ লাখ টাকা ফেরত দিচ্ছে না এবং ১০ থেকে ১২টি মামলা দেওয়ার ভয় দেখিয়ে হুমকি প্রদান করছে।’
এ বিষয়ে জুলাই-৩৬ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক লাভলী নাহার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘মনিরুজ্জামান সরকার আমাকে বোন, আমার সন্তানকে ভাগ্নে বলত। এ জন্য আমি তাকে বিশ্বাস করে জমি বাবদ যে টাকা চেয়েছে আমি দিয়েছি। পরে দেখি আমার থেকে তিনি বেশি টাকা নিয়েছেন। তিনি এবং তার লোকেরা আমাকে ঠকিয়েছে। আমি এর বিচার চাই।’
অভিযুুক্তরা প্রতারণা করেছেন আরও একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি ২০১৬-১৭ সাল নাগাদ একটি ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য চুক্তি করেন। জমি বাবদ তিনি ১৫ লাখ টাকা দেন। কিন্তু তারা তাকে সেই জমি বা ফ্ল্যাট কোনোটিই দেননি। পরে তিনি আইনি সহায়তায় কয়েক ধাপে টাকা ফেরত পান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই অধ্যাপক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘অবসরের পরে নিজের একটা ফ্ল্যাটের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু উনাদের প্রতারণায় তা আর হয়নি। আমার কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা একবারে নিলেও পরবর্তীতে তা কয়েক ভাগে ১০ হাজার, ৫০ হাজার করে ফেরত দিয়েছে। এতে আমার টাকাগুলো কোনো কাজে আসেনি। একজন শিক্ষক কীভাবে তার নৈতিকতা বিকিয়ে দিয়ে প্রতারণা করতে পারেন।’
অভিযুক্ত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের থেকে প্রতারণার শিকার হয়েছেন ফোকলোর বিভাগের এক সহযোগী অধ্যাপক। তিনি তাদের প্রজেক্টের শেয়ার নিয়ে একটি বাড়ি করতে চেয়েছিলেন। এর জন্য তাদের জমি এবং কন্সট্রাকশন বাবদ প্রায় ৩০ লাখ টাকা দেন। এই টাকায় তাকে যে জমি দেওয়া হয় পরবর্তীতে দেখা যায়, সে জমি আগেই সড়কের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এতে ওই প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং ওই শিক্ষকের টাকা আটকে যায়।
ভুক্তভোগী ওই শিক্ষক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার প্রায় ৩০ লাখ টাকা নেন মনিরুজ্জামানরা। তারা আমাকে আমার প্রাপ্ত জমি বুঝিয়ে দেননি। আজ প্রায় ৮ বছর হলো আমার টাকা আটকে আছে। আমার বাড়ি করার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে।’
যা বলছেন অভিযুক্ত শিক্ষক-কর্মকর্তা
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান সরকার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি তাদের সবার জমি ও পাওনা বুঝিয়ে দিয়েছি। আমার কাছে কোনো টাকা পাবেন না। আমি অসুস্থ। এখন কথা বলতে পারব না।’
ইউনিসিটি ক্যামেলিয়া প্রজেক্টের সভাপতি অধ্যাপক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি একটা প্রজেক্টের দায়িত্বে ছিলাম সেখানে আমার সঙ্গে কারো টাকা নিয়ে ঝামেলা নেই। লাভলি নাহারের স্বামী কেন বারবার হুমকি ও অভিযোগ দিচ্ছেন তা আমার জানা নেই। এর আগে এ বিষয়ে যতবার সভা হয়েছে তিনি কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি।’ একটি সভার রেজুলেশনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘ওই সভার সিদ্ধান্ত কমিটি অনুমোদন দেয়নি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডেপুটি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মমিনুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘লাভলী নাহার ম্যামের সঙ্গে অধ্যাপক মনিরুজ্জমান সরকারের একটা ঝামেলা সম্পর্কে আমি জেনেছিলাম। তবে এটার সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’
এ বিষয়ে জানতে হিসাব শাখার ডেপুটি ডিরেক্টর (হিসাব) কাজী মামুন রানার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
অভিযুক্তদের জামায়াতের রাজনীতির সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা জামায়াতের আমির ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘তাদের ২-১ জন জামায়াতের। উনাদের সবাই জামায়াতের না। তা ছাড়া অভিযোগের বিষয়টি সম্পর্কে আমি এখন অবগত না। খোঁজ নিয়ে বলতে পারব।’
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, আমি যতদূর জানি, বিষয়টি তাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ের সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কোনো বিষয় এখানে নেই। ফলে তাদের এই বিষয়গুলোর সমাধান পুলিশ-প্রশাসনের মাধ্যমেই নেওয়া ভালো হবে।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন