শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২৫, ০৪:১৬ পিএম

সোনাদিয়ার মেরিনো

ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২৫, ০৪:১৬ পিএম

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

আকস্মিক আহ্বানে যাত্রা শুরু, সেদিন ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর, ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল আটটা ছুঁয়েছে। অনেক আগেই শরতের প্রকৃতির স্নিগ্ধতা চারিপাশে ছড়াতে শুরু করেছে। ঠিক তখনই মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল বন্ধু আসিফের নাম। ওপাশ থেকে তার উদ্দীপিত কণ্ঠস্বর, যেন এক অ্যাডভেঞ্চারের তূর্যধ্বনি! কোথায় যাবি? কুতুবদিয়া? কক্সবাজার? নাকি মহেশখালী? পর্যটকের মন তো! অচেনাকে জানার দুর্নিবার আকাক্সক্ষা। কুতুবদিয়ার লোনা হাওয়া বা কক্সবাজারের চিরচেনা বালুকাবেলায় পায়ের ছাপ আগেই অঙ্কিত। তাই এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে উত্তর দিলাম, মহেশখালী। সে বলল দুপুরের পর প্রস্তুত থাকতে। কিন্তু নিয়তির লিখন ছিল বুঝি ভিন্ন! পাঁচ মিনিট না পেরোতেই আবার সেই চঞ্চল ডাক, যেন এক অনিবার্য আকর্ষণ, এখনই বের হ! মহেশখালীই যাব! এই আকস্মিকতায় মনটা এক ঝটকায় আনন্দের ফড়িং হয়ে গেল। দ্রুত স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিলাম, কারণ ভ্রমণের নেশা এমনই, সময়কে স্থির থাকতে দেয় না, বরং দ্রুত পথ চলার ইশারা করে। চিরিঙ্গা নতুন জনতা মার্কেটের সামনে আসিফের সঙ্গে দেখা হতেই একটা অটো রিকশা নিলাম। গন্তব্য, চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠ স্কুলের সম্মুখে আমাদের রোকন ভাইয়ের দোকান। আমাদের সফরের মূল পরিকল্পনাকারী আসিফ। রোকন ভাইসহ বাইকে চেপে আমাদের ত্রয়ীর যাত্রা শুরু হলো। উদ্দেশ্য সোনাদিয়া দ্বীপ, এটা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার অন্তর্গত কুতুবজোম ইউনিয়নে অবস্থিত একটি দ্বীপ। এটি জীববৈচিত্র্যের দ্বীপ নামে পরিচিত এবং এই দ্বীপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পিপাসুদের জন্য অন্যতম পর্যটন স্থান। চারদিকে গভীর সমুদ্রের সাগরের ঢেউ সমৃদ্ধ, এটি মূলত প্যারাদ্বীপ নামেও পরিচিতি। রোকন ভাই চালকের আসনে এক দক্ষ সারথির মতো, আমি মাঝখানে এক নীরব দর্শক, আর আসিফ পেছনে বসে তার সমস্ত উদ্দীপনা ভাগ করে নিচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা যখন দশটা ত্রিশ মিনিটের ঘর পেরিয়ে ছুটছে, তখন আমরা গতিময় রাস্তার দখল নিয়েছি। অপেক্ষার প্রহর ও মানবিক উষ্ণতার স্পর্শ সময়ের ডানা মেলে দুপুর একটার আগেই আমরা ঘটিভাঙ্গা এসে পৌঁছলাম। এখানে সড়কপথের সমাপ্তি; সামনে শুধু জলপথের আহ্বান। সোনাদিয়া যেতে হবে ইঞ্জিনচালিত নৌকায়। কিন্তু সব শুভ কাজের পথেই যেন সামান্য বিলম্ব থাকে। জানলাম, সবসময় নৌকা পাওয়া যায় না। হয় অনেক মানুষের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে, নয়তো দেড় হাজার টাকা গুনে পুরোটা রিজার্ভ করে নিতে হবে। জনপ্রতি পঞ্চাশ টাকায় স্থানীয়দের সঙ্গে যাওয়ার অপেক্ষায় সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। ভ্রমণ তো শুধু গন্তব্যে পৌঁছানো নয়, পথের অভিজ্ঞতা আর অপেক্ষাটুকুকেও উপভোগ করা। অপেক্ষা দীর্ঘ হবে বুঝে পাশের এক স্থানীয় হোটেল থেকে দুপুরের আহার সেরে নিলাম। পেট ভরে খেয়ে মন ও শরীর দুইটাই শান্ত হয়েছে আর সেই ফাঁকে মাথায় এলো বাইক রাখার চিন্তা। ওই এলাকার রকি ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর জানতে পারলাম সে এখন সৌদি আরব তাই তিনি ধরিয়ে দিলেন হৃদয় ভাইয়ের নম্বর। কী এক অদ্ভুত সমাপতন! এই হৃদয় ভাই ছিলেন আমাদের আহারের হোটেলের মালিকের ভাইপো। প্রথম দর্শনেই হৃদয় ভাইয়ের আন্তরিকতা ছিল হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। তার ব্যবহার ছিল এতটাই স্নেহময় ও সহজ, যেন আমরা বহুদিনের চেনা। এই উষ্ণতাটুকু প্রমাণ করে, ভ্রমণের পথে স্থান যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মার সংযোগ। দ্বিপ্রহরের আহার শেষে তৃষ্ণা মেটাতে দুই লিটার জলের বোতল নিলাম, কারণ জানতাম, দ্বীপের প্রকৃতি কেবল চোখ জুড়াতে পারে, কিন্তু গলা ভেজাতে পারে না। বিকেল আড়াইটায়, অবশেষে আমাদের কাক্সিক্ষত ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি এলো। প্রায় আধঘণ্টা পর, যখন আমাদের নৌকা সোনাদিয়ার ঘাটে ভিড়ল, তখন সময় যেন কিছুটা থমকে গেছে। সোনাদিয়ার লবণাক্ত জলের মায়াভূমি ও প্রকৃতির পাঠ নৌকাযোগে আসার পথে লবণাক্ত জলজ গাছের সারি আর মাঝে মাঝে ভেসে ওঠা ছোট দ্বীপের দৃশ্য দেখে মন ভরে গেল। জল এতটাই পরিষ্কার ও শীতল যে মুখে নিয়ে দেখলাম বিশুদ্ধ লবণের স্বাদ! প্রকৃতির এই অনাবিল সৌন্দর্য দেখলে পাথর হৃদয়ের মানুষও এক লহমায় গলে যেতে বাধ্য। নৌকা থেকে নেমে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ পেরোতেই চোখে পড়ল ঘন ঝাউ বাগান আর তার পাশেই বিশাল সমুদ্রের অনন্ত বিস্তার। বিশাল খোলা মাটে গরু ছাগলের ঘাস খাওয়ার দৃশ্য এবং গাছে নানা ধরনের রঙিন পাখির কিচিরমিচির মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়। দ্বীপটি তখন সম্পূর্ণ নির্জন। প্রায় দেড় হাজার মানুষ এখানে বাস করলেও তারা থাকে পূর্বপ্রান্তে। পশ্চিমের দিকটা বিশাল খোলা প্রান্তর ঘোরাঘুরির জন্য আদর্শ। শীতকালে পর্যটকের আনাগোনা বাড়লেও, এই অবেলায় আমরা তিনজনই যেন সোনাদিয়ার একমাত্র অতিথি। এই নির্জনতা যেন এক অপার্থিব শান্তি নিয়ে এলো মনে। সাগরের বালিতে অজস্র লাল কাঁকড়ার ছোট ছোট গর্ত আর তাদের দলবদ্ধ ছুটে চলা। সাদা, রঙিন আর ভগ্নপ্রায় শামুক ও ঝিনুকের মেলা চারদিকে। সমুদ্রের ঢেউয়ের বিকট গর্জন, আর সাগরের দিক থেকে ছুটে আসা লবণাক্ত বাতাসের স্পর্শ যেন মনকে এক অজানা মুক্তির স্বাদ এনে দিল। সেখানে আমাদের সঙ্গী হলো একটি কুকুর, তার নাম জানি না। কিন্তু তার সান্নিধ্য আর দ্বীপের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে আমি তার নাম দিলাম, মেরিনো। সে যেন এক চেনা বন্ধুর মতোই আমাদের পথ দেখাল। আরও দেখাল তার নিত্যদিনের শিকার কৌশল, বালির গর্ত খুঁড়ে কাঁকড়া বের করা, তারপর গায়ে ঘষে সেটিকে নিস্তেজ করে ফেলা। কুকুর কাঁকড়া খেল না, কিন্তু প্রকৃতির এই রূঢ় কিন্তু স্বাভাবিক লীলা দেখতে পেলাম। দ্বীপের নীরবতা ভেঙে এবার ফেরার পালা। দ্রুত সমুদ্রতীরে এসে খেয়াল করলাম, যে নৌকায় এসেছিলাম সেটি আমাদের ফেলে চলে যাচ্ছে। আর কোনো লোকাল বোট নেই। মাগরিবের আজান পড়ল। শেষ পর্যন্ত, দেড় হাজার টাকার পরিবর্তে হৃদয় ভাইয়ের মধ্যস্থতায় এগারোশ টাকায় একটি রিজার্ভ বোটে ঘটিভাঙ্গা ফিরলাম। দ্বীপের অস্তিত্বের সংকট ও ঐতিহাসিক পরিচয় যদিও একটি দিনের ঝটিকা সফর শেষ হলো, সোনাদিয়া দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর স্থানীয় মানুষদের আন্তরিকতার গভীর ছাপ হৃদয়ে গেঁথে রইল। চিনি না, জানি না, নেই কোনো পরিচয় কিন্তু যখন ইঞ্জিন চালিত নৌকা পাচ্ছিলাম না তখন কয়েকজন খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে থেকে যেতে বলছিল। এটাই সবচেয়ে ভালো লাগার মুহূর্ত। আবার একটি তিক্ত সত্য মনকে খারাপ করল। দেখলাম, কিছু লোভী মানুষের কারণে দ্বীপের সৌন্দর্য এবং অস্তিত্ব রক্ষার ঢালস্বরূপ ঝাউ গাছগুলো নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়েছে, যা দ্বীপের অস্তিত্বের জন্য এক গুরুতর হুমকি। দ্বীপটি আজ যেমনই হোক, এর ইতিহাস কিন্তু রহস্যে মোড়া।

ভূতত্ত্ববিদদের মতে, বাঁকখালী নদীর স্রোতধারা ও মহেশখালী প্রণালীর সঙ্গে সাগরের ঢেউয়ের সংঘর্ষে এখানে বালি জমে দ্বীপের জন্ম। লোকমুখে প্রচলিত, প্রায় শত বছর আগে পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবলে পড়ে সোনাবাহী এক জাহাজ এই উপকূলে ডুবে যায়। সেই স্বর্ণডুবি থেকেই হয়তো দ্বীপের নাম হয়েছে সোনাদিয়া। আবার কেউ কেউ বলেন, এক সময় এখানে মুক্তার চাষ হতো, যা সোনার দামে বিক্রি হতো। যাই হোক, এই দ্বীপের ম্যানগ্রোভ বন এবং দুর্লভ জীববৈচিত্র্য তাকে দিয়েছে ‘প্যারাদ্বীপ’ উপাধি। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে সৈকতে লাল কাঁকড়ার বিচরণ, শীতকালে সামুদ্রিক কাছিমদের ডিম পাড়ার দৃশ্য সবই যেন প্রকৃতির এক অদ্ভুত অলঙ্করণ। শীতকালে এখানে ভিড় করে দেশি-বিদেশি জলচর পাখি, যার মধ্যে বিরল প্রজাতির চামচঠোঁটি বা কোদালঠোঁটি চা পাখিও রয়েছে। নভেম্বরের শুরু থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এই দ্বীপ ভ্রমণের সেরা সময়। শেষ গন্তব্য, কক্সবাজারের পথে অনির্দিষ্ট যাত্রা ঘটিভাঙ্গায় এসে হঠাৎই নতুন এক পরিকল্পনা জন্ম নিল, কক্সবাজার! বাইকে চেপে দ্রুত চলে গেলাম গোরকঘাটা। রাত আটটায় বাইকসহ বোটে করে চলে গেলাম কক্সবাজার। কক্সবাজারের সমুদ্রের ডাকে সেদিন রাতে সাড়া দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিয়তি এবারও বাধা দিল। রোকন ভাইয়ের একটি জরুরি পারিবারিক কাজের জন্য আমাদের তিনজনকেই ফিরতে হলো। কক্সবাজার থেকে ফিরতি পথে মাঝখানে গাড়ি থেকে নেমে রামুর ‘ভাই ভাই হোটেলে’ রাতের খাবার সারলাম। অবশেষে, পেকুয়া উপজেলার শিলখালী যখন পৌঁছালাম, তখন রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। সোনাদিয়া দ্বীপের এই সফর ছিল এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি। দ্বীপবাসীদের সরল জীবনযাপন এবং প্রকৃতির নিবিড় পাঠ, এই অভিজ্ঞতা বিলাসবহুল রিসোর্ট থেকেও পরম পাওয়া।

ভ্রমণকারীর জন্য নির্দেশিকা

সোনাদিয়া দ্বীপে পৌঁছানোর পথ: বাসে/ট্রেনে ঢাকা থেকে কক্সবাজার। ট্রেনে যেতে প্রায় ৯ ঘণ্টা লাগে। কক্সবাজার ৬নং জেটি (কস্তুরী ঘাট) থেকে  গোরকঘাটা। গোরকঘাটা থেকে অটোরিকশা অথবা সিএনজিতে ঘটিভাঙ্গা। ঘটিভাঙ্গা থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সোনাদিয়া দ্বীপ ( ৫০ টাকা/জন, রিজার্ভ ১৫০০ টাকা) অথবা ঢাকা থেকে চকরিয়া রুটে যেতে চাইলে প্রথমে ঢাকা থেকে বাসে করে চকরিয়া যেতে হবে। চকরিয়া থেকে সিএনজি-তে বদরখালি হয়ে গোরকঘাটা বাজার। গোরকঘাটা বাজার থেকে ঘটিভাঙ্গা, অতঃপর ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সোনাদিয়া।

থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা: সোনাদিয়ায় কটেজ বা তাঁবুতে (ক্যাম্পিং) থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। স্থানীয়দের বাড়িতেও থাকার ব্যবস্থা করা যায়। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে তাদের অফিসেও থাকা যেতে পারে। ক্যাম্পিংয়ের জন্য পশ্চিমপাড়া সবচেয়ে নিরাপদ।

অন্যদিকে শীতকাল ছাড়া অন্য সময় গেলে খাবার নিয়ে যাওয়া ভালো। স্থানীয় বাজারে সাধারণ খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব সৈকতে শুঁটকিপল্লী বিখ্যাত।

একদিনের সফরে আনুমানিক খরচ: ঢাকা থেকে কক্সবাজার/চকরিয়া যাতায়াত- ১০০০ টাকা (কম বেশি)। কক্সবাজার/চকরিয়া থেকে সোনাদিয়া পর্যন্ত স্থানীয় যাতায়াত- ২০০ টাকা (সামান্য কম বেশি)। খাবার- ৫০০ টাকা (নিজের মতো), থাকা (কটেজ/তাঁবু) ২৫০ টাকা।

Link copied!