বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে নতুন বন্দোবস্তের ঘোষণা দিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একঝাঁক তরুণের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বন্যাসহ একাধিক ঘটনায় এনসিপির ডাকে মানুষের বিপুল সাড়া দলটিকে নিয়ে সবাইকে আশাবাদী করে। তবে প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই চাঁদাবাজি, অর্থ কেলেঙ্কারি, অন্তর্কোন্দলসহ নানা ইস্যুতে হোঁচট খেতে শুরু করে দলটি। ফলে সাধারণ মানুষের মনে দলটি নিয়ে যে ‘আকাক্সক্ষা’ তৈরি হয়েছিল, তা বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পড়তে বর্তমানে শূন্যের কোঠায় নেমেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সময় যত গড়িয়েছে, তাদের নানান কর্মকা-ে মানুষের আকাক্সক্ষা কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় দাঁড়িয়েছে। যদিও দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, এনসিপির মতো নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠেনি। মানুষ এখনো এনসিপিকে আগের মতোই ভালোবাসে এবং গ্রহণ করে।
উত্তাল ’২৪-এর ৩ জুলাই ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের এক দফার ঘোষণা দেন এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম। সে সময় নাহিদ ইসলামসহ ছাত্রনেতাদের ডাকে সারা দেশের রাজপথে নেমে আসে জনগণ। ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। অভ্যুত্থানের পর একাধিক ঘটনায়ও তাদের ডাকে বিপুল সাড়া দেখা যায়। তবে, এনসিপি গঠনের পর থেকেই দলের অবস্থান এবং কর্মকা- নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়ক এবং তরুণদের নিয়ে গঠিত এই দল সরকারি সমর্থনে ও পৃষ্ঠপোষকতা সৃষ্টি হয়েছে কি নাÑ এমন প্রশ্নও উঠেছে বহুবার। দল গঠনের শুরু থেকেই বিতর্কে জড়ান এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীর। তার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যবই ছাপার কাগজে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। নৈতিক স্খলনের অভিযোগ ওঠে দলের এক কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়কের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম মহানগরের যুগ্ম সমন্বয়কারী নিজাম উদ্দিনের চাঁদাবাজি এবং রাজধানীর গুলশানে সাবেক এক এমপির বাসায় সমন্বয়ক পরিচয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এ ছাড়া গত বছরের অগাস্টের পর থেকে সারা দেশেই সমন্বয়ক পরিচয়ে ক্ষমতা প্রদর্শন, চাঁদাবাজি, তদবিরসহ নানা অভিযোগ আসতে থাকে দলটিরি বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাভারে সমন্বয়ক পরিচয়ধারী এক যুবককে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দের পর মামলা দায়ের করা হয়।
তিনি দলবল নিয়ে একটি বাড়িতে তল্লাশির জন্য গিয়ে চাঁদা দাবি করেছিলেন। একই বছরের ডিসেম্বরে প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও মানহানির অভিযোগে করা এক মামলায় ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কথিত সমন্বয়ককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের কাছে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন। এনসিপির রংপুরের এক নেতার গত মার্চ মাসে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ভিডিও ও অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হয়। চলতি বছরের এপ্রিলে খুলনা নগরীতে একটি বাড়িতে ঢুকে গোয়েন্দা, পুলিশ-ডিবি ও সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে চার শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশে দেয় জনতা। সর্বশেষ, এনসিপির ঢাকা মহানগরের দুই গ্রুপ আর্থিক লেনদেনের বিষয়কে কেন্দ্র করে সংঘাতে জড়ায়। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে শহিদ আবু সাঈদ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে দলের ঢাকা জেলা ও দুই মহানগর শাখার সমন্বয় সভা চলাকালে এ ঘটনা ঘটে। যদিও পরবর্তী সময়ে দলের শীর্ষ নেতারা জানান, ব্যক্তিগত আর্থিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নাহিদ-সারজিস-হাসনাতদের দেখে মানুষের মধ্যে আশা জেগেছিল। একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তারা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্ন উবে যেতে শুরু করেছে। মানুষের আকাক্সক্ষার ইতিবাচক রূপান্তর ঘটাতে পারছে না এনসিপি। পুরোনো বন্দোবস্তের বিলোপ চেয়ে রাজনীতিতে নামা এনসিপির অনেকেই পুরোনো আদলে শোডাউন করছেন, মহড়া দিচ্ছেন, করছেন তদবির, দেন-দরবার, অন্তর্কোন্দলে জড়াচ্ছেন। তবে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোরও সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তারা।
এনসিপি ছাড়ছেন নেতারা : নেতাদের নানা কার্যকলাপের কারণে প্রায়ই দলটির বিভিন্ন পর্যায় থেকে পদত্যাগের খবর আসছে। একটি গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, গত দুই মাসে এনসিপি থেকে প্রায় ২৭ নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন। এ সময় একাধিক কমিটি স্থগিতও করা হয়েছে। এদিকে, ১ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভার্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত এক জরিপ অনুসারে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে এনসিপি খুব সুবিধা করতে পারবে না।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্ল্যাটর্ফম থেকে আত্মপ্রকাশ করা একটি নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শামসুল আলম সেলিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘তাদের নিয়ে আশা-আকাক্সক্ষা এখনো রয়েছে সাধারণ মানুষের। তবে নানান বিতর্কিত কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়া এবং কিছু নেতার অতি-উৎসাহী আচরণের কারণে জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে নিজেদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ দেখলাম, তাদের একটি সমাবেশে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এর আগেও অনেকের নামে আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে, যাদের দল থেকে বহিষ্কার এবং অনেককে আবার বহাল করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে মোটা দাগে যত ছাত্র আন্দোলন সফলতা পেয়েছে, তাদের কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করেনি। তারা অন্যতম শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। গণঅভ্যুত্থানের পরই রাজনৈতিক দল গঠন এবং বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় তাদের জনপ্রিয়তা অনেকাংশে ক্ষুণœ হয়েছে। আগামীর বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে হলে তাদের দুর্বলতা কাটিয়ে আর্থিক প্রোলভন থেকে বের হয়ে আসতে হবে, তা না হলে তাদের গণভিত্তি থাকবে না।’
জনআকাক্সক্ষা পূরণ এবং দলের অবস্থান তুলে ধরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও রাজনৈতিক পর্ষদের সদস্য আবদুল হান্নান মাসউদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষ আমাদের নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা পুরোপুরি পূরণ করতে পারিনি। আমাদের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সব ভুলত্রুটি কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিষয়গুলো মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে দলীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়। শাহবাগের ঘটনা মূলত দুজনের ব্যক্তিগত লেনদেনের ইস্যুকে কেন্দ্র করে একটি ঘটনা ঘটায়। মিডিয়ায় আসছে পদ ভাগাভাগিসহ অন্তর্দ্বন্দ্ব। তবে যা হয়েছে, এটিও কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এনসিপি গঠনের প্রথম থেকেই আওয়ামী প্রপাগান্ডসহ নানামুখী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। নতুন দল হিসেবে দেশের অন্য বৃহৎ দলের নানান অপপ্রচারের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক দল এমন প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে উঠেছে কি না, তা বিরল। দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠার পর নানান দল তাদের সমর্থন করেছে, তবে এনসিপির ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো থেকে আমরা প্রথম থেকেই সমালোচনা পেয়েছি।’
শাহবাগের ঘটনার বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, শাহবাগের ঘটনাটি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, রেশারেশির জের থেকে ঘটেছে। এর সঙ্গে দলের বা এনসিপির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে ঘটনা যাই হোক, এটি কোনোভাবেই সর্মথনযোগ্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দলে আর্থিক লেনদেনের অঘোষিত সংস্কৃতি আছে, যা কোনোভাবেই চলতে পারে না। সামগ্রিকভাবে আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়গুলোর যে সংস্কৃতি, তার পরিবর্তন প্রয়োজন। সামগ্রিক পরিবর্তন না হলে যে দলই গঠন হবে, তার ভেতরে এমন ঘটনা ঘটবে। আমরা ভবিষ্যতে চেষ্টা করব শাহবাগের মতো এমন ঘটনা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করতে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তারা যত বেশি দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত থাকতে পারবে, তত তাদের রাজনীতি টিকে থাকবে। যতটা নাগরিকের কাছাকাছি যেতে পারবে, ততটাই তারা মূল্যায়িত হবে। এক সমাবেশে নানা ধরনের মানুষ যেতে পারে। তবে তাদের অবস্থান নির্ধারিত হবে আগামী নির্বাচনে তারা কতটা ভোট পাবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন