ভালো নেই সাদাপাথর। তার বুক এখনো ভারী। প্রতিনিয়তই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া যায় চারপাশে। অতিসামান্য হলেও পাথর ফিরেছে। তবে জৌলুস ফেরেনি। চারদিকে এখনো ক্ষত। পাথরখেকোদের হিংস্রতা আর ধারালো নখের আঁচড়ের দাগ।
একসময় যেখানে মুগ্ধতা ছড়াত সাদা সাদা পাথর। চারদিকে বিস্তৃত ছিল, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিছানো ছিল পাথরের পসরা, সেখানটা আজ যেন বিস্তীর্ণ বালুভূমি। ছোট ছোট পাথরের টুকরো, এখানে-সেখানে, অল্প-অল্প পাথর বিছিয়ে রাখা হয়েছে। দেখলে বোঝাই যায়, এই বিছিয়ে রাখা প্রাকৃতিক নয়, কৃত্রিম। পাথরখেকোদের থাবায় সিলেটের পর্যটনের অপার সম্ভাবনার এই স্পট এখন অনেকটাই মরুভূমিতে পরিণত হয়ে আছে।
তবুও সেখানে যাচ্ছেন পর্যটকরা। যেটুকু অবশিষ্ট আছে, সেই সৌন্দর্য উপভোগ করতে তারা ছুটে যান সাদাপাথরে। সেখানে এখন পাথর আগের মতো না থাকলেও ভারতের সেভেন সিস্টার্সের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির পর্বতশৃঙ্গ বেয়ে নেমে আসা জলের ধারা তাদের খানিকটা সান্ত¡না দেয়। সেই জলে সাঁতার কাটলে কিছুটা শীতল হয় মন ও দেহ। সাদাপাথরের মৌলিক সৌন্দর্য না থাকলেও সেখানে যা অবশিষ্ট আছে, তা দর্শনে গুনতে হয় আগের চেয়ে বেশি টাকা। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো আহামরি কিছু সেখানে যেমন নেই, তেমনি নেই পর্যটকবান্ধব পরিবেশও। নেই স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন-ব্যবস্থা। খোলা আকাশের নিচে খালি মাঠে পার্কিং ছাড়া আর কোনো সুবিধা নেই। এমনকি গাড়িচালকদের বসে অপেক্ষা বা বিশ্রাম করার মতো নেই কোনো ব্যবস্থাও। পাথর লুটের পর সাদাপাথরের সৌন্দর্য ম্লান হলেও তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অন্য কোনো সুবিধা বাড়ানো হয়নি। বাড়ানো হয়নি বাড়তি কোনো সৌন্দর্য। তবে বাড়ানো হয়েছে পার্কিং ফি। ৮ জনের নিচে কোনো নৌকায় যাত্রী উঠতে দেওয়া হচ্ছে না, সে শিশু হোক আর কোলের বাচ্চা হোক! অভিযোগ উঠেছে, পাথর লুটের মাধ্যমে সৌন্দর্য লুটপাটের পর এখন পর্যটকদের পকেটের পয়সা হাতিয়ে নিতে তৎপর সেখানকার সংশ্লিষ্ট সবাই। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সাদাপাথরে পর্যটকসেবা ছেড়ে দিয়েছে লিজগ্রহীতার মর্জির ওপর। সম্প্রতি সরেজমিন সাদাপাথর ঘুরে এলে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। উঠে আসে ধলাই সেতুর পাশে বালু লুটের চিত্রও।
কিছুদিন আগে সাদাপাথর লিজ ছিল সিলেট শহরের মোস্তাফিজুল ইসলামের নামে। গত মাসে সেই সাদাপাথর পর্যটন এলাকা ৩ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার টাকায় ৬ মাসের জন্য লিজ নিয়েছেন সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার মো. লিলু মিয়া। তার সঙ্গে আছেন নজরুল ইসলাম ও কাওছার আহমদ নামের আরও দুজন। লিজের পুরো বিষয় স্থানীয়ভাবে দেখভাল করছেন সাইদ আব্দুল্লাহ। তারা সাদাপাথর লিজ নিয়েই বাড়িয়ে দিয়েছেন পার্কিং ফি। ৮ জনের বেশি কোনোভাবে যাত্রী নেওয়া যাবে নাÑ এমন বিধি-নিষেধ আরোপ করেন শক্তভাবে। কিন্তু স্পটের কোনো উন্নয়ন করা হয়নি। বতর্মানে সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া ২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা, কারের ভাড়া ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০ টাকা, নোহা বা হাইয়েসের ভাড়া ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১২০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। আগে মোটরবাইক বিনা পার্কিং ফিতে রাখা গেলেও এখন ২০ টাকা দিতে হয়।
পর্যটকদের জন্য নৌকাভাড়া আগের মতোই ৮০০ টাকা রাখা হয়েছে। তবে আগে ছোট-বড় মিলে ৯-১০ জন পর্যন্ত উঠতে পারলেও এখন ছোট-বড় কোনো নৌকাতেই ৮ জনের বেশি নিতে দেওয়া হয় না। বাচ্চা-শিশু একজন বেশি হলেই তার জন্য আরেকটা নৌকা নিতে বাধ্য করা হয়। এমন অভিযোগ ঘাটের পর্যটকদের। মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার জন্য পর্যটকদের আসা-যাওয়া বাবদ নৌকার মাঝিকে জনপ্রতি আরও ২০ টাকা করে দিতে হয়।
ঢাকার উত্তরা থেকে আসা মিজানুর রহমান বলেন, ২ বছর আগে একবার এসেছিলাম আর আজকে আবারও এলাম; কিন্তু আগের থেকে ভিন্ন দেখা যাচ্ছে, জৌলুস নেই। বর্তমানে প্রশাসনের উদ্যোগে কিছুটা ফিরেছে বলে অবশিষ্টটুকু দেখতে পাচ্ছি। তা না হলে এটুকুও পেতাম না।
কুয়াকাটা সদর উপজেলা থেকে আসা পর্যটক আলী হোসেন জানান, হাত দিয়ে পাথর ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে প্রকৃতির কোনো স্পর্শ নেই। প্রকৃতির আঁচল হারিয়ে গেছে বালুর নিচে, সাদাপাথর আজ মানুষের হাতে গড়া দৃশ্য। সেখানে রস নেই। রসকষহীন বিরানভূমির মতো লাগছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিন মিয়া বলেন, লিজগ্রহীতা আমাদের অনুমতি নিয়েই ফি বাড়িয়েছেন। আমি অবগত আছি। পর্যটন স্পট এখন আগের চেয়ে ভালো। কোনো অনিয়ম হচ্ছে না।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর একসময় ছিল দেশের অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক। পাহাড়, ঝরনা আর সাদা পাথরের অপূর্ব মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা এ স্থানে প্রতিদিন ভিড় জমাতেন লাখো পর্যটক। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে বদলে গেছে এর চিত্র। আগে পাথর লুটের মহোৎসব দেখা দিলেে এখন তা বন্ধ। কিন্তু লুটপাট থেমে নেই। রাতের আঁধারে এখন চলছে বালু লুট। পর্যটন স্পটের পাশে বাংলাদেশ রেলওয়ের রোপওয়ে ও বাংকার এলাকাগুলো এখন একদম ফাঁকা। যেখানে একসময় ছিল রেলওয়ের বিভিন্ন স্থাপনা। বর্তমানে আছে শুধু বালুর স্তূপ আর বালুখেকোদের রাজত্ব। দিনেও তোলা হয় বালু। রাতের আঁধারে নৌকায় সেই বালু নিয়ে যাওয়া হয় গন্তব্যে। খানিকটা দূরে ধলাই সেতুর পাশটা লিজ দেওয়া। সেই লিজের বালুর সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হয় এই বালুকে। ১ ফুট বালুর জন্য ৪ টাকা রয়েলিটি দিয়ে কাজ সেরে ফেলা হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ কলাবাড়ী এলাকায় ধলাই নদীর তীরবর্তী শতবর্ষী সড়ক ও কবরস্থানসহ বিভিন্ন স্থাপনা বালুখেকোদের কারণে ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ধলাই ব্রিজ থেকে ইসলামগঞ্জ বুধবারি বাজারমুখী সড়কটি যেকোনো সময় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারেÑ এমন আশঙ্কা স্থানীয়দের। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ধলাই নদীর ব্রিজ, রাস্তা, কবরস্থান, বিদ্যালয়, বাজার ও সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা মারাত্মক ঝুঁকির মুখে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তি নিজেদের ‘রেকর্ডভুক্ত জমি’ দেখিয়ে এবং গোষ্ঠীগত প্রভাব খাটিয়ে নদীর পাড় কেটে অবাধে বালু উত্তোলন করছেন। ইজারার সীমা অতিক্রম করে প্রতিদিন রাতের আঁধারে ড্রেজার মেশিন দিয়ে স্টিল নৌকা ও ছোট বারকি নৌকা করে বালু লুটপাট চলছে। স্থানীয় একজন জানান, আমরা বারবার উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় স্থানীয়রা এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেনÑ কখন শত বছরের পুরোনো রাস্তা ও ব্রিজ ধসে পড়ে সেই ভয়ে। তাদের দাবি, রাস্তার পাশের নদীপাড় একসময় ছিল প্রায় ২০০ ফুট চওড়া। বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র ৪ ফুটে! আরও কিছুদিন এভাবে যদি বালু উত্তোলন করা হয়, তাহলে হয়তো ধসে পড়বে পুরো সড়ক ও কবরস্থান। অথচ ধলাই নদীর এই ব্রিজই পূর্ব ইসলামপুর ও উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের একমাত্র যোগাযোগমাধ্যম। এটি ধসে পড়লে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হবেন ২ ইউনিয়নের বাসিন্দারা।
স্থানীয় বিএনপি নেতা মাশুক আহমেদ বলেন, অবৈধভাবে নদীর তীর ভেঙে বালু উত্তোলনের কারণে দক্ষিণ কলাবাড়ী থেকে বুধবারি বাজার পর্যন্ত সড়ক ও আশপাশের এলাকা এখন বিপর্যস্ত। স্কুল, ক্লিনিক, বাজারÑ সবই ঝুঁকির মুখে। স্থানীয় যুবক নজরুল ইসলামের অভিযোগ, প্রতিবাদ করতে গেলে আমাদের হুমকি দেয়। এমনকি নারী নির্যাতনের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়। উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় বালু লুটের কাজটি করছেন বালুর লিজগ্রহীতারা।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিন মিয়া কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বলেন, পর্যটনের বাইরে কোনা বক্তব্য দিতে পারব না। কথা বলতে চাইলে এ প্রতিবেদককে তিনি অফিসে গিয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন।
কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশের ওসি রতন শেখ বালুখেকোদের কারণে সড়ক ও নদীর ঝুঁকির মধ্যে থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, ব্রিজে এরই মধ্যে ফাটল ধরেছে। সড়কটিও হুমকির মুখে। আমরা চেষ্টা করছি লুট রোধ করতে। নদীর কাছে সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন করেছি। যেটি বিজিবির করার কথা, সেটি আমরা করছি। ব্রিজ ও সড়ক সব কিছু রক্ষা করতে হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন