বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জুলাই জাতীয় সনদ এক বিশেষ মুহূর্তের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র পুনর্গঠনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, সেই প্রতিশ্রুতির সবচেয়ে দৃশ্যমান রূপ ছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কারের পরিকল্পনা প্রণয়ন। অর্ধশতাধিক বৈঠক, দীর্ঘ আট মাসের আলাপ-আলোচনা ও নানা মত ও পথ পেরিয়ে ২৫টি রাজনৈতিক দল যখন একটি সনদে স্বাক্ষর করেছিল, তখন মনে হয়েছিল, দীর্ঘদিনের বিভক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতর থেকে বাংলাদেশ অবশেষে এক নতুন ঐক্যের পথে হাঁটছে।
কিন্তু সেই ঐক্যের অঙ্কুরেই দেখা দিয়েছে ভাঙন। কমিশনের কাজ শেষ হলেও ঐকমত্যের পথ এখনো অচল। সংবিধান সংস্কারের পদ্ধতি ও গণভোটের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতানৈক্য, অভিযোগ, সন্দেহ আর অবিশ্বাসের দোলাচলে ‘জুলাই সনদ’ এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
বিএনপি বলছে, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে হতে হবে, দুই ব্যালটে ভোটের ব্যবস্থা করে। তাদের যুক্তি, জনগণের চূড়ান্ত মতামত একদিনেই নেওয়া উচিত। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনে করছে, গণভোট আগে হতে হবে, নির্বাচন পরে। কারণ একই দিনে দুটি ভোটগ্রহণ হলে বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার ঝুঁকি বাড়বে। আবার এনসিপি বলছে, গণভোটের আগে নতুন সংসদকে গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়া দরকার। না হলে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব জনগণের সামনে নিয়ে যাওয়া রাষ্ট্রীয় পদ্ধতির পরিপন্থি হবে।
বিএনপি অভিযোগ করছে, তাদের দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বাদ দেওয়া হয়েছে। তারা বলছে, এটি জনগণকে বিভ্রান্ত করার রাজনৈতিক প্রচেষ্টা। অন্যদিকে কমিশন সমর্থক দলগুলো দাবি করছে, বিএনপি ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে এবং ঐকমত্য প্রক্রিয়াকে ভাঙার চেষ্টা করছে। এই পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতি এখন জাতীয় ঐকমত্যের চেতনা ও উদ্দেশ্য উভয়কেই বিপন্ন করে তুলছে।
ঐকমত্য কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল কেবল একটি দলিল তৈরি নয়, বরং রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক সংস্কারের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য কাঠামো তৈরি করা। গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনিক জবাবদিহি, দুর্নীতি দমন, মানবাধিকার সুরক্ষা এই সবকিছুই জুলাই সনদের মূল লক্ষ্য ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অনৈক্যের কারণে সেই লক্ষ্য এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন সবার দৃষ্টি প্রধান উপদেষ্টার দিকে। কমিশনের সভাপতি হিসেবে তিনি এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন। গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে তার সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ এবং আসন্ন নির্বাচনের গতিপথ। সরকার যদি দ্রুত একটি স্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে নির্বাচন পূর্ব উত্তেজনা আরও বাড়বে, রাজনৈতিক আস্থা ভেঙে পড়বে সেইসঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যাবে।
একটি বিষয় এখন স্পষ্ট, জনগণ আর রাজনৈতিক নাটক দেখতে চায় না। তারা চায় সুশাসন, জবাবদিহি, মানবিক ন্যায়বিচার এবং অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র। এই চাহিদাই ছিল জুলাই সনদের প্রেরণা। কিন্তু সেই জনগণের আশা যেন দলীয় কলহে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মনে রাখা উচিত, এই সনদ কেবল রাজনৈতিক প্রতীক নয়, এটি জনতার আকাক্সক্ষার দলিল।
ঐক্যের আহ্বান যতই শক্তিশালী হোক, বাস্তবায়নের প্রশ্নে দলীয় অবস্থানই তাদের শেষ কথা। এটাই বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মূল চরিত্র। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো এমন জায়গায় পৌঁছায়নি, যেখানে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া যায়। অথচ রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সকল পক্ষের উচিত ছিল বৃহত্তর জনগণের প্রত্যাশা, স্বপ্নকে প্রাধান্য দেওয়া, নিজের রাজনৈতিক অবস্থান নয়।
আমরা মনে করি, একটি নতুন, জবাবদিহিমূলক, মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে হলে দলীয় সীমানা পেরিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। জুলাই সনদ সেই ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে, যদি আমরা এখনই আত্ম-সমালোচনার মাধ্যমে বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসি।
আমরা আশা করব, জুলাই সনদ নিয়ে সব জটিলতা দূর হবে। এই সনদের স্বপ্ন হোক জাতির ঐক্যের ভিত্তি, বিভাজনের নয়। এখনই সময় সিদ্ধান্তের, এখনই সময় সাহসী ঐক্যের। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যেন দলীয় স্বার্থ নয়, জাতীয় চেতনার আলোয় আলোকিত হয়।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন