সিরিয়ার দক্ষিণের সুয়েইদা প্রদেশে গত সুন্নি বেদুঈন ও দ্রুজ গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের মধ্যে টানা পাঁচ দিন ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘাত চলছে। এই সংঘাতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৫০ জনে দাঁড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার এক যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি এই তথ্য জানিয়েছে। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস নামের সংস্থাটি জানায়, রোববার থেকে শুরু হওয়া সংঘাতে নিহতদের মধ্যে ৭৯ জন দ্রুজ যোদ্ধা ও ৫৫ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। সংস্থাটি জানায়, নিহতদের মধ্যে ২৭ ব্যক্তিকে প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাহিনী ‘ঠা-া মাথায়’ হত্যা করেছে। রক্তক্ষয়ী সংঘাত শেষে সুয়েইদা অঞ্চলে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ইসরায়েল ও সিরিয়া। দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সিরিয়া ও ইসরায়েলের সরকারপ্রধান।
এদিকে দামেস্কে হামলার পর তেল আবিবের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিয়েছে আঙ্কারা। গভীর রাতে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর সুয়েইদায় অস্ত্র সজ্জিত কয়েকশ গাড়ি। তবে শহরটিতে প্রবেশের বদলে ত্যাগ করছে সিরীয় সেনারা। কারণ সিরিয়ার দ্রুজ ও বেদুইন সম্প্রদায়ের মধ্যে ৪ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাত নিরসনে সম্মত হয়েছে ইসরায়েল ও সিরিয়া। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর এক পোস্টেই পাল্টে যায় পরিস্থিতি। এক্স বার্তায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বুধবার (১৬ জুলাই) রাত থেকেই সংঘাত বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মত হয়েছে দুই পক্ষ।
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। সংঘাতকে দুই প্রতিবেশীর ভুল বোঝাবুঝি বলে মন্তব্য করেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র। এর আগে বুধবারই সিরিয়ার দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষায় ৪ দিনের সংঘাতে প্রথমবারের মতো সিরিয়ায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দামেস্কের প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস এলাকা ও সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর। এ সময় প্রাণ হারান বেশ কয়েকজন। ইসরায়েল জানায়, সিরিয়ার জিহাদি সরকারকে দক্ষিণে অগ্রসর হতে দেওয়া হবে না। বিপরীতে বিমান হামলাকে সিরিয়ার নিরাপত্তা বিঘিœত করার ইসরায়েলি কৌশল হিসেবে অভিহিত করেছেন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল শারা। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল শারা বলেন, ‘দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা আপনাদের তৃতীয় পক্ষের খেলনা হওয়া থেকে বিরত রাখতে চাইছি। জনগণকে রক্ষায় অধিকাংশ সময়ই সংগ্রাম করেছি।
তাই আমরা যুদ্ধে ভয় পাই না। তবে বিশৃঙ্খলার বদলে সিরিয়ান জনগণের স্বার্থকে আমরা প্রাধান্য দিয়েছি।’ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সিরিয়াকে আমরা বেসামরিক এলাকা হিসেবে কার্যকর রাখব। কারণ এটি ইসরায়েলের সীমান্তকে সুরক্ষা দিচ্ছে। আরেকটি লেবানন তৈরি হতে দেওয়া যাবে না। তাই সিরিয়ায় আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’ ইসরায়েলের কার্যকলাপের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল হতে দেওয়া যাবে না বলে দাবি করেছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জানান, ইতিমধ্যেই গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তেল আবিবের কাছে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে আঙ্কারা। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বলেন, ‘ইসরায়েল যেভাবে গোটা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করছে, আমরা সেটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। এ বিষয়ে আমরা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখছি। অবশ্যই এমন বিষয় বরদাশত করা হবে না।
অস্থিতিশীলতাকে মেনে নেওয়া হবে না।’ বিশ্বব্যাপী কৌশলগত উপদেষ্টা এবং ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি বিশেষজ্ঞ মার্কো ভিসেনজিনো বলেছেন, সিরিয়ার নেতা আহমেদ আল-শারা সুয়েইদা অঞ্চল থেকে সরকারি বাহিনী প্রত্যাহার করে ‘বাস্তবতার’ কাছে মাথা নত করেছেন। কারণ ইসরায়েলি আক্রমণের প্রেক্ষাপটে তিনি সেখানে সেনা রাখার অবস্থানে নেই। বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) ভিসেনজিনো আলজাজিরাকে বলেন, (আল-শারার) প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো দেশে শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা এবং সেখানে নতুন সিরিয়ায় সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্ত করা।
তিনি বলেন, ‘তাই আমি মনে করি, বাস্তবিকভাবে বলতে গেলে, তিনি বুঝতে পারছেন যে, তিনি যা করতে পারেন তাতে তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু একদিকে তিনি দেশে বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর ঝুঁকিতে আছেন, বিশেষ করে তার রাজনৈতিক ভিত্তির সঙ্গে। কিন্তু অন্যদিকে, যদি (ইসরায়েলি) বোমা হামলা অব্যাহত রাখার হুমকি থাকে, তবে তিনি সেখানে উপস্থিতি ধরে রাখতে পারবেন না।’ সম্প্রতি সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে (যেখানে দ্রুজ এবং আল-শারার বাহিনীর মধ্যে লড়াই চলছে) - সেখান থেকে সরকারি বাহিনী প্রত্যাহার না করা হলে হামলা বৃদ্ধির হুমকি দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে বুধবার কয়েকটি ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দেশটি দাবি করেছে, এই হামলা সিরিয়ার দ্রুজ জনগোষ্ঠীর সমর্থনে চালানো হয়েছে, যারা সম্প্রতি সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে। সিরীয় সরকার জানিয়েছে, এই হামলায় অন্তত তিনজন নিহত হয়েছে। হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতায় নামে, যেন সংঘর্ষটি আরও বড় সংঘাতে রূপ না নেয়।
সিরিয়া পরে গুরুত্বপূর্ণ সুয়েইদা শহর থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে সম্মত হয় এবং দ্রুজ মিলিশিয়াদের সঙ্গে একটি নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তিও করে। সংবাদমাধ্যম সিএনএন স্বাধীনভাবে এই পরিসংখ্যান যাচাই করতে পারেনি এবং সিরীয় সরকারের কাছেও তারা প্রতিক্রিয়া চেয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) ভোরে টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা বলেন, তাদের সামনে দুটি পথ ছিল, ‘হয় ইসরায়েলের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ, যার খেসারত আমাদের দ্রুজ নাগরিকদের জীবন দিয়ে দিতে হবে, নয়তো দ্রুজ ধর্মীয় নেতাদের শান্তির পথে ফিরে এসে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া।