- ইসরায়েলি হামলায় গাজায় প্রতিদিন ১০০ শিশু হতাহত হচ্ছে: জাতিসংঘ
- দেড় বছরে ইসরায়েলি হামলায় নিহত শিশু ১৮ হাজার ৫০০ ছাড়াল
- গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৬৯ ফিলিস্তিনি নিহত
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার বাসিন্দা ঈমান আল নূরির ছোট সন্তান দুই বছর বয়সি সিরাজ। গত কয়েক দিন ধরেই অসুস্থ। ক্ষুধা ও অসুস্থতায় কান্না করে দিনমান। সিরাজের ১৪ বছর বয়সি চাচাতো বোন সামা এবং তার বড় দুই ভাই ৯ বছরের ওমর আর ৫ বছরের আমির। তারা তিনজন অসুস্থ সিরাজকে দেইর আল-বালাহ এলাকার আলতায়ারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি গাজা উপত্যকার ঠিক মাঝখানে। সেদিনের মর্মস্পর্শী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বিবিসিকে ঈমান আল নূরি বলেন, ‘মেডিকেল পয়েন্টটা তখনো বন্ধ থাকায় তারা ফুটপাতে বসে ছিল, এ সময় হঠাৎই গোলার শব্দ পেলাম। আমি আমার স্বামীকে বললাম: ‘তোমার ছেলেরা তো সেখানেই গেছে।’
৩২ বছর বয়সি পাঁচ সন্তানের মা ঈমান হামলার শব্দ শুনে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, তার ছেলেরা এবং ভাতিজি একটি গাধা দিয়ে টানা গাড়িতে শুয়ে আছে। এ ধরনের টানা গাড়ি আহতদের হাসপাতালে নিতে ব্যবহার করা হয়। কারণ সেখানে কোনো অ্যাম্বুলেন্স নেই। আমির আর সামা মারা গেছে। ওমর ও সিরাজ গুরুতর আহত।
ঈমান বলেন, ‘ওমর তখনো শ্বাস নিচ্ছিল। ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়। ওর রক্ত দরকার ছিল, আর সেটা আনতে এক ঘণ্টা লেগে যায়। তাকে রক্ত দেওয়া হয়, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। ওরা মারা গেল কেন? ওদের কী দোষ ছিল? ওদেরও স্বপ্ন ছিল পৃথিবীর অন্য সব বাচ্চার মতোই। যদি ছোট একটা খেলনাও দিতেন, খুব খুশি হয়ে যেত। ওরা তো শুধুই নিষ্পাপ শিশু ছিল।’
সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলি হামলা প্রকট আকার ধারণ করেছে। চলতি বছর ইসরায়েলি হামলায় মাত্র এক দিনে ১৮৩ শিশু নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এসব মৃত শিশু হয়তো এখন শুধুই সংখ্যায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু তারা পরিবারের কাছে ছিল একেকটি স্বপ্ন, একেকটি ভবিষ্যৎ; যা চিরতরে নিভে গেল। গাজার বিভিন্ন প্রান্তে এখনো নিষ্পাপ শিশুরা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে, কেউ মা-বাবার কোলে চিরনিদ্রায় শায়িত, কেউ হাসপাতালের করিডরে শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চারদিকে শুধু কান্না আর আহাজারি।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত সাড়ে ১৮ হাজারেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে। মোট নিহতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৪৩০। গত সপ্তাহে সংস্থাটি জানায়, গাজায় প্রতিদিন অন্তত ২৮ ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়। গাজায় ইসরায়েলের চলমান হামলার পর থেকে ফিলিস্তিনি শিশুরা ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছে।
সরকারি প্রতিবেদন অনুসারে, হতাহতের ৬০ শতাংশের বেশি নারী ও শিশু, যাদের সংখ্যা বর্তমানে ৬১ হাজার ছাড়িয়েছে। ফিলিস্তিনের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সিরা ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ, যার মধ্যে পশ্চিম তীরে ৩৪ লাখ এবং গাজায় ২১ লাখ শিশু রয়েছে। এক নতুন প্রতিবেদনে জানা গেছে, গাজায় ৩৯ হাজারের বেশি শিশু অনাথ হয়েছে। অর্থাৎ, তারা তাদের এক বা উভয় পিতামাতাকে হারিয়েছে। নিহত শিশুদের মধ্যে কেউ কেউ জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছে। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা আনাদোলু। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা গেছে, নিহত শিশুদের অনেকেই ছিল জীবনের একেবারে প্রারম্ভে। কেউ কেউ জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েলি বিমান হামলা বা বোমার আঘাতে মারা গেছে।
এদিকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় গত ২৪ ঘণ্টায় দখলদার ইসরায়েলি হামলায় আরও ৬৯ জন নিহত হয়েছে। এবং আহত হয়েছে আরও অন্তত ৩৬২ জন। গত সোমবার সন্ধ্যার পর এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত শুক্রবার পর্যন্ত গাজায় মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৪৩০ এবং আহত হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৭৫ জন। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কেবল হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানো নিহত ও আহতদেরই এ পরিসংখ্যানে ধরা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা বা সড়কে পড়ে থাকা বহু মৃতদেহ উদ্ধার সম্ভব হয়নি। উদ্ধার সরঞ্জামের অভাব এবং অব্যাহত বোমাবর্ষণের কারণে প্রকৃত নিহত ও আহতের সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গাজায় সামরিক হামলার পাশাপাশি খাদ্য ও ত্রাণ সরবরাহ সীমিত করে দিয়েছে ইসরায়েল। ফলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। অভিযানের শুরু থেকে এ পর্যন্ত অপুষ্টি ও খাদ্যাভাবজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে ২২২ জনের, যাদের মধ্যে ১০১ জনই শিশু। শুধু গত সোমবারই অপুষ্টিতে মারা গেছে এক শিশুসহ ৫ জন। ত্রাণ সংগ্রহে আসা সাধারণ ফিলিস্তিনিদেরও লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে ইসরায়েলি সেনারা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ত্রাণ নিতে গিয়ে নিহত হয়েছে ১ হাজার ৭৭২ জন। এসব হতাহতকেও সামগ্রিক পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহল একাধিকবার গাজায় অভিযান বন্ধের আহ্বান জানালেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেনÑ হামাসকে পুরোপুরি অকার্যকর করা ও জিম্মিদের মুক্ত না করা পর্যন্ত এই অভিযান চলবে।