প্রতারণার মাধ্যমে ‘দখল’ করে রেখেছেন ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’র পদ। এখন সেই ‘দখল’কে বৈধতা দিতে প্রায় এক বছর আগের পুরোনো তারিখে, তৎকালীন গভর্নিং বডির সভাপতি ও সদস্যদের স্বাক্ষর জাল করে একটি ভুয়া রেজুলেশন জমা দিয়েছেন আদালতে। স্বাক্ষর ও রেজুলেশন জালিয়াতির এই কাজটি করেছেন সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা সদরে অবস্থিত দারুল উলুম ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দাবিদার মাওলানা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন। তার স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়টি জানাজানি হলে সিলেটের জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা) লিখিত জানিয়েছেন তৎকালীন সভাপতি ও সিলেটের স্বনামধন্য দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সৎপুর দারুল হাদিস কামিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা শফিকুর রহমান এবং মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা নোমান আহমদ। এমনকি সে সময়কার গভর্নিং বডির সকল সদস্য ও মাদ্রাসার একাধিক শিক্ষকও মাওলানা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়টি প্রশাসনকে অবহিত করেছেন।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের কাছে নাজিম উদ্দিনের জালিয়াতির বিষয়টি শিকার করেন তারা। তাদের অভিযোগ, জোর করে পদ দখলকারী নাজিম উদ্দিন নিজের পদ বাঁচাতে মূলত এই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। তৎকালীন সভাপতি, সিলেটের প্রবীণ আলেমে দ্বীন অধ্যক্ষ মাওলানা শফিকুর রহমান দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যে তারিখের এবং যে সভার রেজুলেশন দেখানো হয়েছে, সে রকম কোনো সভা ওই তারিখে হয়নি। সেখানে সভা করে রেজুলেশন করার প্রশ্নই আসে না। নাজিম উদ্দিন তার প্রতারণাকে ষোলো আনা বাস্তবায়ন করতে এই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি আমার এবং গভর্নিং বডির প্রত্যেক সদস্যের স্বাক্ষর জাল করেছেন। রেজুলেশন করেছেন ভুয়া। এত বড় প্রতারণা কোনো মাদ্রাসার শিক্ষক করতে পারেন না।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (মানবসম্পদ ও উন্নয়ন) এবং পদাধিকার বলে মাদ্রাসার বর্তমান গভর্নিং বডির সভাপতি পদ্মসেন সিংহ জানান, তিনি এ রকম অভিযোগ শুনেছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অনিয়ম প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাদ্রাসা সূত্র জানায়, একই সময়ে দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির অভিযোগে চাকরিচ্যুত হওয়া মাওলানা খলিলুর রহমানের মামলা চলছে আদালতে। সেই মামলায় বিবাদী হিসেবে রয়েছেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা নোমান আহমদ। একটি ‘ষড়যন্ত্রের’ কারণে মাওলানা নোমান বর্তমানে মাদ্রাসার বাইরে থাকায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন মাদ্রাসার বিতর্কিত শিক্ষক মাওলানা নাজিম উদ্দিন। ‘ভারপ্রাপ্ত’ দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি অধ্যক্ষ পদে নিজের আসন পাকাপোক্ত করতে নানান পন্থা অবলম্বন করতে শুরু করেন। তারই অংশ হিসেবে মাওলানা খলিলুর রহমানের মামলার বিবাদীর জায়গায় নিজের নাম সংযুক্ত করে ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গত ১৭ জুলাই সিলেটের সহকারী জজ আদালতে একটি আবেদন জমা দিয়েছেন। সেখানে তিনি অধ্যক্ষ নোমান আহমদের জায়গায় ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’ হিসেবে তার নাম যুক্ত করার আদেশ চেয়েছেন। এ জন্য নথি হিসেবে আদালতে জমা দিয়েছেন জাল স্বাক্ষর করা গভর্নিং বডির একটি রেজুলেশন। এই রেজুলেশনে সভার তারিখ দেখানো হয় ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ইংরেজি। একই দিনে দারুল উলুম ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা নিয়ে বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অফিসে একটি পূর্বনির্ধারিত সভা ছিল। যেখানে শিক্ষকসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। একই দিনে মাদ্রাসায় গভর্নিং বডির সভা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অফিসে পূর্বনির্ধারিত সভা দেখানোয় নাজিম উদ্দিনের জালিয়াতির বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
সূত্র জানায়, ভুয়া রেজুলেশনে গভর্নিং বডির ১১ সদস্য উপস্থিত দেখানো হয়েছে। কিন্তু সেখানে স্বাক্ষর আছে ৬ জনের। সদস্যরা জানান, তাদের প্রত্যেকের স্বাক্ষর জাল। নাজিম উদ্দিন যে কয়টি পেরেছেন সে কয়টি স্বাক্ষর দিয়েছেন। তৎকালীন বডির দাতা সদস্য ফয়জুল ইসলাম বলেন, আমার নাম উপস্থিতি তালিকায় দেখানো হয়েছে। অথচ আমি ছিলাম না। মাদ্রাসার শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে সভায় উপস্থিতি দেখানো হয় মাওলানা মনজুর আহমদকে। তার স্বাক্ষরও আছে রেজুলেশনে। তিনি বলেন, আমি উপস্থিত ছিলাম না, এটি আমার স্বাক্ষর নয়। এদিন কোনো সভা মাদ্রাসায় হয়নি। সবাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে মিটিংয়ে ছিলেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিজের মনোবাসনা সফল করতে এই মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত মাওলানা নাজিম উদ্দিনের সাথে কথা বলতে পরপর দুদিন তার সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। এমনকি পরিচয় দিয়ে একাধিক বার্তা পাঠালেও তিনি তার কোনো জবাব দেননি।