বুলেট-বোমায় দমবন্ধ শৈশব। পড়ালেখার জন্য বিশ্বের শিশুরা যখন বইয়ের ব্যাগ নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটছে, ঠিক তখন একমুঠো খাবারের আশায় ছোটাছুটি করছে গাজার শিশুরা। মৌলিক সেবার সম্পূর্ণ বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যেও স্কুলে ফেরার স্বপ্ন দেখছে গাজার শিশুরা। তাদের জীবনে নেই কোনো স্থিরতা, নেই খেলা কিংবা শেখার সুযোগ। এমনকি অনেকের নেই আপন পরিবারও। তবুও তারা বারবার জানিয়ে দিয়েছে, স্কুলে ফিরে যাওয়া তাদের জীবনের প্রথম চাওয়া। এটি তাদের স্বাভাবিকতার অনুভূতি। বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সুযোগ। আর সেই সঙ্গে জ্ঞান অর্জনের প্রতিষ্ঠান।
গাজার বাস্তুচ্যুত বাবা মাহের বলেছেন, কয়েক দিন আগে আমার সন্তান বলেছে, আমি পুষ্টিকর খাবার খেতে চাই। আমি সত্যিই আবার স্কুলে যেতে চাই। আমার আগের, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাই।’ ইসরায়েলি আগ্রাসনে গাজার ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় অসংখ্য শিশু সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাবর্ষ থেকে বঞ্চিত। এ অবস্থায় ধ্বংসস্তূপের নগরীতে কিছুটা হলেও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে তাঁবুতে অস্থায়ী শ্রেণিকক্ষ গড়ে তুলেছেন একদল শিক্ষক। স্বেচ্ছায় দেওয়া হচ্ছে পাঠদান।
সেপ্টেম্বর থেকে বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থীদের নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু। তবে ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত ফিলিস্তিনের গাজার সে সুযোগ পাচ্ছে না। নেতানিয়াহুর সেনারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলাকে বোমায় গুঁড়িয়ে দেওয়ায় নেই শ্রেণিকক্ষ, নেই কোনো শিক্ষার উপকরণ। যখন অধিকাংশ দেশের শিশুরা নতুন পোশাক আর বই নিয়ে শ্রেণিকক্ষে হাজির হচ্ছে, তখন গাজার শিশুরা তাদের ব্যাগ নিয়ে এদিক-সেদিক ছুটছে এক মুঠো খাবারের জন্য। সব মিলিয়ে বলা যায়, শিক্ষাব্যবস্থাসহ ভেঙে পড়েছে তাদের সব মৌলিক অধিকার। গাজার শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা পৃথিবীর অন্যান্য শিশুদের মতো স্কুলে যেতে পারছি না। তারা নতুন পোশাক পরে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যায় আর আমরা আমাদের ব্যাগ খাবার সংগ্রহের কাজে লাগাই। আমার মন চায় স্কুলে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বসে পড়ালেখা করতে।’ শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা অধিকারবঞ্চিত।
জন্মের পর থেকে যুদ্ধের মধ্যেই বসবাস করছি। গাজার বাইরের সব শিশু পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু আমরা প্রায় দুই বছর ধরে পড়াশোনা করতে পারিনি।’ এ অবস্থায় শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ যেন অন্ধকারে ডুবে না যায়, তাই এ ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য লড়াই করছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষাগুরু। তাঁবুর ভেতর গড়ে তোলা হয়েছে অস্থায়ী শ্রেণিকক্ষ। যেখানে স্বেচ্ছায় শিশু-কিশোরদের পাঠদান শুরু করা হয়েছে। শিক্ষকরা বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম যে, আরবসহ অন্যান্য দেশের মতোই আমরাও আমাদের স্কুল এবং শ্রেণিকক্ষ থেকে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু করব। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। তাই আমরা অধ্যাপক আহমেদ আবু রিজকের নেতৃত্বে এভাবেই শিক্ষার্থীদের পাঠদান দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।’
গাজা সিটি দখলের জন্য ইসরায়েলি বাহিনী আক্রমণের মাত্রা বাড়ানোয় তাঁবুর ভেতর স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকদের এই শিক্ষাকার্যক্রমও নিরাপদ নয়। আর ভ্রাম্যমাণ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীর শিক্ষা নিশ্চিতও অসম্ভব। এই কঠিন পরিস্থিতিতে কিছুটা হলেও, শিক্ষিত জাতি গড়ার কাজে নিজেদের বিলিয়ে দিতে চান শিক্ষকরা। শিক্ষকরা বলেন, ‘বেশির ভাগ শিশুই এখন রাস্তায় থাকে। তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার মতো স্কুল অবশিষ্ট নেই। এ অবস্থায় যতটা সম্ভব আমরা চেষ্টা করছি তাদের শিক্ষা যাতে নিশ্চিত করা যায়। আমরা যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে এটি চালু রাখতে চাই।
কারণ শিক্ষিত মানুষই একটি জাতির শক্তি।’ ফিলিস্তিনের শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ বারহাম জানান, গাজার ৩০৭টি স্কুলের মধ্যে ২৯৩টি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। আর জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয়ের তথ্য, জুলাই মাসে স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ক্ষতির মূল্যায়ন অনুসারে গাজার ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত। যেখানে পুনরায় কার্যক্রম শুরুর জন্য যার ৯১ শতাংশ প্রতিষ্ঠানেরই বড় ধরনের পুনর্বাসন বা সম্পূর্ণ পুনর্গঠন প্রয়োজন।
সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে সম্মতির কথা জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস। পাশাপাশি যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা পরিচালনা করতে একটি স্বাধীন জাতীয় প্রশাসন গঠন করতে চায় সংগঠনটি। এদিকে গাজায় হামলা আরও জোরদার করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এতে এক দিনে উপতক্যাজুড়ে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৭৩ ফিলিস্তিনি। আইডিএফের সামরিক অভিযানের মুখে উপত্যকাটির উত্তরাঞ্চল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে বাসিন্দারা।
সবশেষ পাওয়া খবর পর্যন্ত বৃহস্পতিবার অবরুদ্ধ উপত্যকা গাজায় প্রাণ গেছে আরও ৩৭ ফিলিস্তিনির, যাদের মধ্যে ২২ জনই উপত্যকার সবচেয়ে বড় নগরী গাজা সিটির বাসিন্দা। কাতারি সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিহতের তালিকায় রয়েছে চার ত্রাণপ্রত্যাশীও। এ ছাড়া, গত ২৪ ঘণ্টায় অনাহারে মৃত্যু হয়েছে আরও তিন ফিলিস্তিনির।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন