ফিলিস্তিনের সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত শেখ রাদওয়ান। অবরুদ্ধ গাজা সিটির এই প্রধান আবাসিক এলাকায় কয়েক ডজন ইসরায়েলি ট্যাংক ও সামরিক বাহন ঢুকে পড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা। ইসরায়েলি বাহিনীর স্থল অভিযানের দ্বিতীয় দিনেই গাজা শহর দখলের লক্ষ্যে অভিযান শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বিবিসি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ট্যাংক, বুলডোজার ও সাঁজোয়া যানগুলো উত্তর গাজা সিটির শেখ রাদওয়ানের দিকে চলেছে। নিজেদের আড়াল করার জন্য ইসরায়েলি বাহিনী কামানের গোলা ও স্মোক বম্ব নিক্ষেপ করায় চারদিকে মেঘের মতো ঘন ধোঁয়া দেখা গেছে।
যুদ্ধের আগে এই শেখ রাদওয়ান এলাকায় কয়েক হাজার মানুষের বসবাস ছিল। এটি সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত। কোনো উপায় না পেয়ে আল-মাওয়াসির দিকে যাচ্ছিলেন ৬৩ বছর বয়সি এক ফিলিস্তিনি। ইসরায়েলের নৃশংসতার মুখে এ নিয়ে সপ্তমবার বাস্তুচ্যুত হলেন তিনি। এই বৃদ্ধ বলেন, ‘আমি আমার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে খুবই ভয়ের মধ্যে আছি। আমার সঙ্গে শুধু একটি কম্বল আছে। ২৫ কিলোমিটারের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। তাই অন্য কিছু নিতে পারিনি।’
এদিকে গাজা নগরী থেকে বাসিন্দাদের পালানোর জন্য একটি সাময়িক পথ খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। বাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল আভিচে আদ্রি বলেন, আজ দিনের মধ্য সময় থেকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার জন্য পথটি খোলা থাকবে। এখন পর্যন্ত গাজার উপকূলবর্তী একটি পথ দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছিলেন ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েলের দাবি, হামাসের হাতে আটক পণবন্দিদের মুক্ত করতে এবং হামাসের আনুমানিক তিন হাজার যোদ্ধাকে পরাজিত করতে তারা গাজা সিটিতে অভিযান চালাচ্ছে। ইসরায়েল হামাসের এই দলটিকে ‘সবশেষ শক্ত ঘাঁটি’ হিসেবে অভিহিত করেছে। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই অভিযানের ব্যাপক নিন্দা করা হয়েছে।
বুধবারের ইসরায়েলি বাহিনীর অনুপ্রবেশের পর আশপাশের ভবন ও প্রধান সড়কগুলোতে ভারী বিমান হামলা চালানো হয়। একে স্থল অভিযানের প্রস্তুতি বলে ধারণা করছেন শেখ রাদওয়ানের বাসিন্দারা। স্থানীয় বাসিন্দা সাদ হামাদা পরিবার নিয়ে বুধবার সকালেই দক্ষিণে চলে গেছেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘ড্রোনগুলো কিছুই বাকি রাখেনি। তারা সোলার প্যানেল, বিদ্যুৎ জেনারেটর, পানির ট্যাংক, এমনকি ইন্টারনেট নেটওয়ার্কেও আঘাত করেছে।’ তিনি বলেন, ‘জীবন চালিয়ে নেওয়া একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপদ থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ মানুষ চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।’ আবু ইস্কান্দার, আল তাওয়াম ও আল সাফতাওয়ি এলাকাগুলো শেখ রাদওয়ানের অন্তর্ভুক্ত। আল-জালা সড়ক শেখ রাদওয়ানকে বিভক্ত করেছে। এটি গাজা সিটির মধ্যবর্তী অঞ্চলের সাথে এর উত্তরাঞ্চলীয় এলাকাগুলোকে সংযোগকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক।
শহরের আরো গভীরে ইসরায়েলি বাহিনী নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে এবং কেন্দ্রীয় এলাকাগুলোতে পৌঁছানোর পথ খুলে দিতে পারে বলে জানান স্থানীয়রা। গাজা সিটির সড়কে ট্যাংকের ছবি ছড়িয়ে পড়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে যারা এখনো শহরের পশ্চিম ও কেন্দ্রীয় অংশে রয়েছেন। শেখ রাদওয়ানে ইসরায়েলি বাহিনীর অনুপ্রবেশের ফলে এখন আরেক দফায় মানুষ ঘর-বাড়ি ছাড়তে শুরু করেছে। হাজার হাজার পরিবার দক্ষিণে পালিয়ে যাচ্ছে। এর আগে, মঙ্গলবার আইডিএফ জানায়, প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ গাজা শহর ছেড়ে পালিয়েছে। যদিও আগস্ট থেকে জাতিসঙ্ঘ এই সংখ্যা এক লাখ ৯০ হাজার বলে জানিয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, অন্তত সাড়ে ছয় লাখ মানুষ এখনো সেখানে রয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ২৬ হাজারের মতো শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। এর মধ্যে শুধু গাজা নগরীতে এই সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। এসব শিশুর জন্য জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেয়াসুস সতর্ক করে বলেছেন, উত্তর গাজায় ইসরায়েলের অভিযান অবশিষ্ট হাসপাতালগুলোকে ‘ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে’ পৌঁছে দিয়েছে। সেই সঙ্গে তিনি এই অমানবিক পরিস্থিতির অবসানের দাবি জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) এক এক্স পোস্টে এসব কথা বলেন ডব্লিউএইচও প্রধান। খবর আল-আরাবিয়ার। পোস্টে তিনি লেখেন, ‘উত্তর গাজায় সামরিক অভিযান এবং বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ নতুন বাস্তুচ্যুতির ঢেউ তৈরি করছে, যা আতঙ্কগ্রস্ত পরিবারগুলোকে এমন একটি ক্রমশ সংকুচিত এলাকায় ঠেলে দিচ্ছে, যা মানুষের থাকার জন্য উপযুক্ত নয়।’ তিনি আরও লেখেন, হাসপাতালগুলো ইতিমধ্যেই নিমজ্জিত, আর ইসরায়েলি হামলা বৃদ্ধির জন্য সেগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। সেগুলোতে ডব্লিউএইচও জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম পৌঁছে দিতে পারছে না। গত মঙ্গলবার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসি এলাকার মুখপাত্র টেস ইনগ্রাম। মঙ্গলবারই ইসরায়েলি সেনারা গাজা নগরীতে বড় ধরনের স্থল অভিযান শুরু করেছে। ইনগ্রাম বলেন, আগস্টে গাজায় প্রতি আট শিশুর একজন মারাত্মক অপুষ্টিতে আক্রান্ত ছিল, যা এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ হার। গাজা নগরীতে এই অনুপাত প্রতি পাঁচে একজন। তিনি বলেন, গাজা নগরী থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষকে জোরপূর্বক সরানো হচ্ছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের প্রাণনাশ হতে পারে। ইসরায়েলের স্থল অভিযানের মুখে শহরের পুষ্টিকেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
জাতিসংঘের হিসাবে, গাজা নগরী ও আশপাশের এলাকাগুলোর ১০ লাখ মানুষের প্রায় ৪০ শতাংশ ইতিমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজা নগরীতে স্থল অভিযান শুরুর পর সেখানে প্রচ- হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। জল, স্থল ও আকাশÑ তিন পথেই গাজা উপত্যকার সবচেয়ে বড় এ শহর এলাকায় হামলা হচ্ছে। এমন নৃশংসতার মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে গাজা নগরী ছেড়ে পালাচ্ছেন বাসিন্দারা। তাদের জন্য সাময়িকভাবে একটি পথ খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।