মার্কিন শান্তি প্রস্তাব নিয়ে দর-কষাকষি চলছে দুই দেশের মধ্যেই। এর মধ্যে ফ্রন্টলাইনে রাশিয়া ও ইউক্রেনের তুমুল সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বিশেষ সামরিক অভিযানে মস্কোর সেনারা প্রায় ১ হাজার ৪৫০ জন ইউক্রেনীয় সেনাকে হত্যা করেছে। রিপোর্ট অনুসারে, ব্যাটলগ্রুপ নর্থ এলাকায় ২৮৫ জনেরও বেশি সৈন্য, ব্যাটলগ্রুপ ওয়েস্টে ২৩৫ জনেরও বেশি সৈন্য, ব্যাটলগ্রুপ সাউথে ১৭৫ জনেরও বেশি সৈন্য, ব্যাটলগ্রুপ সেন্টারে ৪৬৫ জনেরও বেশি সৈন্য, ব্যাটলগ্রুপ ইস্টে ২৩৫ জনেরও বেশি সৈন্য এবং ব্যাটলগ্রুপ ডনেপার এলাকায় ৫৫ জনেরও বেশি সৈন্য হারিয়েছে ইউক্রেন। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, কিয়েভের ড্রোন হামলার জবাবে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী কিনঝাল ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা ব্যবহার করে ইউক্রেনীয় সামরিক-শিল্প এবং জ্বালানি সুবিধার বিরুদ্ধে একটি বিশাল হামলা শুরু করেছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রুশ সৈন্যরা ১৫২টি জেলায় জ্বালানি ও পরিবহন অবকাঠামোগত সুবিধা, পাশাপাশি ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর ইউনিট এবং বিদেশি ভাড়াটেদের জন্য অস্থায়ী স্থাপনায়ও হামলা চালিয়েছে। এতে আরও বলা হয়, রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এক দিনে ৩৬৬টি ইউক্রেনীয় ফিক্সড-উইং ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
মন্ত্রণালয় আরও জানায়, ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ৬৬৮টি ইউক্রেনীয় যুদ্ধবিমান, ২৮৩টি হেলিকপ্টার, ১ লাখ ৭৮৮টি ড্রোন, ৬৩৮টি বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, ২৬৪১২টি ট্যাংক ও অন্যান্য সাঁজোয়া যুদ্ধযান, ১৬২৭টি মাল্টিপল রকেট লঞ্চার, ৩১৭৪০টি ফিল্ড আর্টিলারি বন্দুক ও মর্টার এবং ৪৮৪৬৮টি বিশেষ সামরিক মোটরযান ধ্বংস করেছে রুশ বাহিনী। ইউক্রেনের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক শিল্প এলাকা ও জ্বালানি স্থাপনায় কিনজাল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে পাল্টা হামলা চালিয়েছে রুশ সেনাবাহিনী। এ হামলায় মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ১৪৫০ জন সেনা হারিয়েছে ইউক্রেন। শনিবার রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাতে এ খবর জানিয়েছে তাস।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, রাশিয়ায় বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ইউক্রেনের সন্ত্রাসী হামলার জবাবে রুশ সশস্ত্র বাহিনী দূরপাল্লার আকাশ এবং স্থলভিত্তিক নির্ভুল অস্ত্র দিয়ে একটি বিশাল হামলা শুরু করে। এর মধ্যে রয়েছে কিনজাল অ্যারোব্যালিস্টিক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং দূরপাল্লার মনুষ্যবিহীন বিমানবাহী যান। এসব হামলা ১৫২টি জেলায় থাকা ইউক্রেনীয় সামরিক-শিল্প এলাকা ও জ্বালানি স্থাপনার পাশাপাশি ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত বন্দর অবকাঠামো লক্ষ্য করে চালানো হয়। হামলাগুলো নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে বলেও জানায় মন্ত্রণালয়। রাশিয়ার ব্যাটলগ্রুপ সেন্টারের যোদ্ধারা দিমিত্রভে ইউক্রেনের সেনাদের ঘিরে ফেলে হত্যা করেছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে আরও বলা হয়, রুশ বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করে এক দিনে ৩৬৬টি ইউক্রেনীয় ফিক্সড-উইং ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলো মার্কিন তৈরি মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেমের দুটি রকেট এবং ৩৬৬টি ফিক্সড-উইং মনুষ্যবিহীন বিমানবাহী যান ভূপাতিত করেছে।
মন্ত্রণালয় আরও জানায়, ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ৬৬৮টি ইউক্রেনীয় যুদ্ধবিমান, ২৮৩টি হেলিকপ্টার, এক লাখ ৭৮৮টি মনুষ্যবিহীন বিমান, ৬৩৮টি বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা, ২৬ হাজার ৪১২টি ট্যাংক এবং অন্যান্য সাঁজোয়া যুদ্ধযান, এক হাজার ৬২৭টি মাল্টিপল রকেট লঞ্চার, ৩১ হাজার ৭৪০টি ফিল্ড আর্টিলারি বন্দুক এবং মর্টার এবং ৪৮ হাজার ৪৬৮টি বিশেষ সামরিক মোটরযান ধ্বংস করেছে রুশ বাহিনী। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান শনিবার ঘোষণা করেছেন যে, তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির প্রস্তুতি হিসেবে কয়েক দিনের মধ্যে রাশিয়ায় একটি ব্যাবসায়িক প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছেন। খবর বার্তা সংস্থা এএফপির। বসন্তে আইনসভা নির্বাচনের আগে কেসকেমেটে এক বিশেষ সমাবেশে আরবান মস্কো এবং ওয়াশিংটনের সাথে বুদাপেস্টের বৈদেশিক সম্পর্ক নিয়ে এক বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রতিনিধিদলের উদ্দেশ্য হবে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া, বিশেষ করে যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে যেখানে রাশিয়াকে পশ্চিমা অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন না করে বরং পুনরায় একত্রিত করা। জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী এমন এক ইউরোপীয় নেতা, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন উভয়েরই ঘনিষ্ঠ। তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘তিনি ওয়াশিংটন এবং মস্কোর সঙ্গে আলোচনা করছেন, যদিও তিনি বলেন যে ‘প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত এখনই বলা উচিত নয়।’
ইউক্রেনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদায়ি দূত কিথ কেলগ বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিচুক্তি এখন খুবই কাছাকাছি এবং তা মূলত দুইটি বড় বিষয় সমাধানের ওপর নির্ভর করছে। যার একটি হলো দোনবাস অঞ্চলের ভবিষ্যৎ এবং অন্যটি হলো জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ। রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার হামলা শুরু করে। এর আগে দোনবাস অঞ্চলে রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ইউক্রেনীয় বাহিনীর মধ্যে আট বছরের লড়াই চলছিল। দোনবাস দোনেৎস্ক ও লুহানস্কÑ এই দুই অঞ্চল নিয়ে গঠিত। ইউক্রেন যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘাত এবং রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। কেলগ রিগ্যান ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোরামে বলেন, আলোচনার অগ্রগতি এখন শেষ ১০ মিটারে, যা তিনি সবচেয়ে কঠিন ধাপ হিসেবে বর্ণনা করেন।
কেলগ বলেন, এই দুইটি বিষয় সমাধান করতে পারলেই বাকি বিষয়গুলো সহজেই এগোবে। আমরা প্রায় পৌঁছে গেছিÑ সত্যিই খুব কাছাকাছি। ভিয়েতনাম, পানামা ও ইরাকে যুদ্ধ করা এই সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধে হতাহত মানুষের সংখ্যা ভয়াবহ এবং আঞ্চলিক যুদ্ধে এমন মাত্রার ক্ষয়ক্ষতি নজিরবিহীন। তিনি দাবি করেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দুই পক্ষ মিলিয়ে নিহত ও আহত মিলিয়ে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে রাশিয়া ও ইউক্রেন কেউই তাদের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির নির্ভরযোগ্য সংখ্যা প্রকাশ করে না।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তিবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং তার জামাতা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে খুবই গঠনমূলক একটি ফোনালাপ হয়েছে। জেলেনস্কি বলেন, ফোনালাপে আলোচনা হয়েছে কীভাবে সম্ভাব্য কোনো শান্তিচুক্তি হলে রাশিয়াকে তা মানতে বাধ্য করা যায় এবং আমি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে অটল রয়েছি। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারাও যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি শহর থেকে এই ফোনালাপে যোগ দেন, যেখানে তারা রাশিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার মার্কিন উদ্যোগ বিষয়ে টানা তৃতীয় দিনের মতো আলোচনা করছেন। এই আলোচনার পরও মস্কো কোনো উল্লেখযোগ্য ছাড় দিতে রাজি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না এবং ইউক্রেনে ব্যাপক বোমাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে। জেলেনস্কি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লেখেন, ইউক্রেন প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৎভাবে কাজ চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি আরও বলেন, আমরা বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি এবং এমন গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরেছি, যা রক্তপাত বন্ধ করতে এবং রাশিয়ার নতুন পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের হুমকি দূর করতে সহায়তা করতে পারে।
ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর বিষয়টি রাশিয়ার ওপরই ছেড়ে দিলেন কিয়েভ ও ওয়াশিংটনের প্রতিনিধিরা। ফ্লোরিডায় দ্বিতীয় দিনের বৈঠক শেষে ইউক্রেন ও মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যুদ্ধ বন্ধের বাস্তব অগ্রগতি নির্ভর করছে, রাশিয়া এটি বন্ধে কতটা আগ্রহী তার ওপর। এদিকে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার মধ্যেই পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে দুই দেশ। গত (শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর) ইউক্রেনের সামরিক ও জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলা চালায় রাশিয়া। জবাবে রাশিয়ার বন্দর ও তেল শোধনাগারে হামলা চালায় ইউক্রেন। এদিকে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফ জানিয়েছেন, শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত, সম্মুখ সারিতে ১০৬টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, যার মধ্যে পোকরোভস্কের সংঘাতটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। দক্ষিণ রাশিয়ার ক্রাসনোদার অঞ্চলের একটি বন্দর এবং দেশটির সামারা অঞ্চলের একটি তেল শোধনাগারে সফল হামলার দাবিও ইউক্রেনের। এদিকে শনিবার টানা তৃতীয় দিনের মতো ফ্লোরিডার মায়ামিতে আলোচনায় বসছেন ইউক্রেনীয় এবং মার্কিন কর্মকর্তারা। এর আগে শুক্রবার বৈঠক শেষে দুই পক্ষ জানায়, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বাস্তব অগ্রগতি নির্ভর করছে, রাশিয়া এটি বন্ধে কতটা আগ্রহী তার ওপর।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন