মানুষের জৈবিক চাহিদার একটি বস্ত্র। আগে ছেলেদের শার্ট-পান্ট, পাঞ্জাবি মেয়েদের শাড়ি ছিল প্রধান পোশাক; বর্তমানে আধুনিক সমাজে বহির্বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত বদলে যাচ্ছে আমাদের ফ্যাশন। আমাদের দেশের আধুনিক মনস্ক মানুষ খুব দ্রুত তা গ্রহণ করে নিচ্ছে। আমাদের দেশেও প্রসারিত হচ্ছে ফ্যাশনেবল পোশাকের। প্রয়োজন দক্ষ কারিগরের। এ জন্য প্রয়োজন ফ্যাশন ডিজাইনারের; আমাদের দেশেও অনেক ইনস্টিটিউট ফ্যাশন ডিজাইনারের পড়াশোনা চালু আছে। বাংলাদেশের মোট জাতীয় রপ্তানি আয়ের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই আসে পোশাকশিল্প থেকে।
এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ৪০ লাখ লোক। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে এ শিল্পের মাধ্যমে দেশের উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। রেডিয়ান্ট ইনস্টিটিউট অব ডিজাইনের ফ্যাকাল্টি ও সাদাকালো ফ্যাশন হাউসের ফ্যাশন ডিজাইনার ফারহানা দিবা কথা বলছেন ফ্যাশন ডিজাইনিং পেশা হিসেবে কেমন।
ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে কেমন ক্যারিয়ার
এটি এমন একটি শিল্প মাধ্যম যার সাহায্যে একজন ডিজাইনার একটি পোশাককে উপজীব্য করে তার মননশীলতার পরিচয় দেন। ফ্যাশন ডিজাইনাররা বিভিন্নভাবে তাদের কাজগুলো করে থাকেন। কেউ কেউ তাদের আইডিয়াগুলো স্কেচের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন, কেউ সরাসরি ডিজাইনটি পোশাকে ফুটিয়ে তোলেন।
পোশাকশিল্পে সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন, উচ্চ আয়ের এবং যুগোপযোগী পেশা হলো বায়িং বা গার্মেন্টস মার্চেন্ডাইজিং, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফ্যাশন ডিজাইনিং প্রভৃতি। গার্মেন্টস পরিচালনার জন্য দক্ষ পেশাদারের প্রয়োজন। আর এসব পেশাদার শ্রেণির চাহিদা মেটাতে অনেক সময় দেশ ছাড়াও দেশের বাইরে থেকে দক্ষতাসম্পন্নদের আনা হয়। তবে এ জন্য শিক্ষার্থীদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রি থাকা প্রয়োজন। শুধু চাকরি নয়, এসব ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন। কাজেই কারো যদি এসব বিষয়ে প্রফেশনাল ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ থাকে তাহলে তিনি শুরুতেই আকর্ষণীয় বেতনে যেকোনো পোশাকশিল্পে চাকরি পাবেন।
কোর্সসমূহ: ফ্যাশন ডিজাইনে রয়েছে ছয় মাস থেকে এক বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স; অন্যদিকে উচ্চ ডিগ্রির ক্ষেত্রে রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফ্যাশন ডিজাইন অ্যান্ড টেকনোলজি; অ্যাপারেল ম্যানুফেকচার অ্যান্ড টেকনোলজি; নিটওয়্যার ম্যানুফেকচার অ্যান্ড টেকনোলজির ওপর অনার্স কোর্স এবং এমবিএ ইন অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিং প্রভৃতি। এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের পর যেকোনো বয়সের শিক্ষার্থীরা এসব কোর্সে ভর্তি হতে পারবেন।
কোথায় পড়বেন: বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ফ্যাশন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইনস্টিটিউট আছে। তার মধ্যে-
বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, রাফেল ডিজাইন ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজি।
চাকরির সুযোগ: টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, ফ্যাশন ডিজাইনিং বিষয়ে শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশে রয়েছে চাকরির বিশাল বাজার। সরকারি-বেসরকারি দুটি ক্ষেত্রেই রয়েছে চাকরির বিশাল ক্ষেত্র। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের সুযোগের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে স্থাপিত দেশি-বিদেশি টেক্সটাইল মিল, বিভিন্ন বায়িং অফিস, বুটিক হাউস, ফ্যাশন হাউস, গার্মেন্টস শিল্প ও ইন্ডাস্ট্রিতে উৎপাদন কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করে যেতে হয় তাদের। মূলত টেক্সটাইল বিষয়ে শিক্ষার্থীদের যেকোনো ছোট-বড় টেক্সটাইল বা গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির পণ্য উৎপাদন কার্যক্রমের প্রাণ হিসেবে বিবেচিত করা হয়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংক এবং শিল্পঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলোর শিল্পঋণ বিতরণ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ রয়েছে।
ব্যবসার সুযোগ: যদি কেউ চাকরি করতে না চান তবে ফ্যাশন হাউস, ফ্যাশন অ্যাক্সেসরিজের দোকান, কাপড়ের দোকান, টেক্সটাইল, গার্মেন্টসের প্রযুক্তিগত সরঞ্জামের দোকান থেকেও আয় করতে পারেন।
ফারহানা দিবা বলেন, বর্তমান যুগে ফ্যাশন শুধু সৌন্দর্য বা বিলাসিতার বিষয় নয়, এটি একধরনের আত্মপ্রকাশ, সংস্কৃতি ধারণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বাংলাদেশে ফ্যাশন ডিজাইন পেশা হিসেবে দিন দিন জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ, মিডিয়া ও সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মের প্রসার এবং স্থানীয় পোশাকশিল্পের বিকাশ এ পেশাটিকে আরও সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। পেশা হিসেবে ফ্যাশন ডিজাইনের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্প বিশ্বের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ একটি খাত, যা দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। এ খাতে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য দক্ষ ও সৃজনশীল ফ্যাশন ডিজাইনারের চাহিদা অনেক। পাশাপাশি, দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড, বুটিক হাউস, অনলাইন বিজনেস ও ই-কমার্সের বিকাশ ডিজাইনারদের জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মুক্ত করেছে। একজন ফ্যাশন ডিজাইনারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ -
১. সৃজনশীলতা ও ট্রেন্ড বোঝার ক্ষমতা- পরিবর্তনশীল ফ্যাশন ট্রেন্ড সম্পর্কে হালনাগাদ থাকা এবং নিজস্ব আইডিয়া দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করার যোগ্যতা একজন ডিজাইনারের মূল শক্তি।
২. বাজার ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান- স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মানুষের পছন্দ সম্পর্কে জেনে ডিজাইন করতে পারলে তা সহজেই জনপ্রিয়তা পায়। একই সঙ্গে, আন্তর্জাতিক বাজারের রুচিও বুঝতে হবে।
৩. টেকনিক্যাল দক্ষতা, প্যাটার্ন মেকিং, কাটিং, সেলাই, টেক্সটাইল বোঝা ইত্যাদি টেকনিক্যাল স্কিল থাকা জরুরি। ডিজাইন সফটওয়্যার (যেমন অফড়নব ওষষঁংঃৎধঃড়ৎ, ঈখঙ ৩উ) ব্যবহারেও পারদর্শী হতে হবে।
৪. যোগাযোগ ও নেটওয়ার্কিং- ক্লায়েন্ট, প্রোডাকশন টিম ও মার্কেটিং টিমের সঙ্গে দক্ষ যোগাযোগ বজায় রাখা দরকার। নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে নতুন কাজ ও সুযোগ পাওয়া সহজ হয়।
৫. উদ্যোক্তা মানসিকতা: চাইলে একজন ডিজাইনার নিজের ব্র্যান্ড নিয়েও শুরু করতে পারেন। উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, মার্কেটিং কৌশল ও ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। একজন ফ্যাশন ডিজাইনারের নিয়মিত ফ্যাশন শো, সেমিনার, ওয়ার্কশপে অংশ নেওয়া দরকার এতে অন্যদের কাজ সম্পর্কে সরাসরি জানা, অভিজ্ঞতা অর্জন হয়। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিজের কাজ প্রমোট করা। ইন্টার্নশিপ ও ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করা। ট্রেন্ড রিসার্চ করা এবং নতুন নতুন ডিজাইন ট্রাই করা। পোর্টফোলিও তৈরি রাখলে ভালো, যাতে প্রয়োজনে ক্লায়েন্ট বা প্রতিষ্ঠানের কাছে উপস্থাপন করা যায়।
ফ্যাশন ডিজাইন এখন আর শুধু একটি শখ নয় বরং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সম্ভাবনাময় ও লাভজনক পেশা। এ পেশায় সফল হতে হলে প্রয়োজন সৃজনশীলতা, পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাস ও সময়োপযোগী দক্ষতা। সঠিক দিকনির্দেশনা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার নিজের ক্যারিয়ারকে যেমন সমৃদ্ধ করতে পারেন, তেমনি দেশীয় শিল্পকেও তুলে ধরতে পারেন আন্তর্জাতিকভাবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন