পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার এক নিবেদিতপ্রাণ পরিবেশকর্মী মাহমুদুল ইসলাম। দীর্ঘদিন ধরে তিনি গ্রামের মানুষের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং পরিবেশবান্ধব নানা উদ্যোগে কাজ করে আসছেন। নিজ উদ্যোগে তিনি গাছের চারা বিতরণ ও রোপণ, প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার, রাস্তার ঝোপঝাড় অপসারণসহ পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধিতে একের পর এক কর্মসূচি পরিচালনা করেছেন। সমাজসেবা ও পরিবেশ রক্ষায় তার এ ব্যতিক্রমী অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি অর্জন করেছেন ‘জাতীয় পরিবেশ পদক-২০২৪।’
তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরফান হোসাইন রাফি
বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা আর গাছ লাগানোর উদ্যোগ
অনন্য পরিকল্পনাটা কীভাবে এলো?
আমার বাড়িতে একটি পাঠাগার আছে, নাম দিয়েছি প্রকৃতির পাঠাগার। বাড়ির উঠানে রাখা থাকে একটি সাইকেল, তাতে ঝুলিয়ে দিই বই। যখন গাছ লাগানোর কাজে বের হই, তখন আশপাশের মানুষদের বই পড়তে দেই। কেউ সাত দিন, কেউ ১০ দিন রেখে বই পড়ে আবার ফেরত দেয় এবং অন্য বই নেয়। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার পাশাপাশি বই পড়া শেষ হলে উপহার হিসেবে আমি চারা গাছ দেই, যেটা তারা চায়। এভাবেই বই আর গাছকে একসঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাটা এসেছে।
এ ধরনের কাজে যুক্ত হওয়ার প্রেরণা কোথা থেকে পেলেন?
শুরুর দিকে আমি নিজের শখে গাছ লাগাতাম। শহরে গেলেই বিভিন্ন ধরনের চারা নিয়ে এসে বাড়ির আঙিনায় কিংবা আশপাশে রোপণ করতাম। পরে আশপাশের মানুষজন চারা চাইতে শুরু করল, আমিও আনন্দের সঙ্গে তাদের দিতে লাগলাম।
তখনই ভাবলাম এ আনন্দ তো আরও ছড়িয়ে দেওয়া যায়। গাছ বিলি করতে গিয়ে ভীষণ ভালো লেগেছিল। যখন কোনো কাজে আনন্দ পাওয়া যায়, তখন সেটি আরও বেশি করে করতে ইচ্ছা জাগে। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই আমি দূরের গ্রামেও গাছ বিতরণ শুরু করি।
উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
আমার গাছ লাগানোর পাশাপাশি বই আদান-প্রদান করারও অভ্যাস ছিল। সেই শখ থেকেই আমি গড়ে তুলেছি আকাশতলার পাঠশালা যেখানে বই পড়া, পরিবেশ নিয়ে কাজ করা আর গাছ লাগানোই মূল উদ্দেশ্য। কোনো গ্রামে গেলে আমি বাচ্চাদের গল্প শোনাই, তাদের হাতে বই তুলে দিই। এমনকি মা-চাচিরাও এসে গল্প করেন, বই পড়েন। আর আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা একেবারেই সরল। আমি মাটির কাছাকাছি থেকে নিজের মতো করেই কাজ করে যেতে চাই। আজকের পৃথিবীতে প্রকৃতি ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আমি চাই ছোট ছোট উদ্যোগের মাধ্যমে হলেও পরিবেশকে কিছুটা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। যত দিন বেঁচে থাকব, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ কাজ চালিয়ে যাওয়াই আমার লক্ষ্য।
‘জাতীয় পরিবেশ পদক-২০২৪’ অর্জন করার অনুভূতিটা কেমন ছিল?
এ পদক আমার কাছে যেন মায়ের হাতে তুলে দেওয়া একটি অর্জন। আমি যে কাজ করি, গাছ লাগানো, প্লাস্টিক-দূষণ দূর করা বা বর্জ্য অপসারণ! সবই করি নিজের আনন্দের জন্য, পাশাপাশি পরিবেশ আর দেশের জন্য। অনেকেই নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করেছেন, কিছুটা খারাপও লেগেছে, তবে শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে আমি মাটির জন্য, পরিবেশের জন্য কাজ করছি। এটাই সবচেয়ে বড় শান্তি। আর সেই কাজের স্বীকৃতি যখন সরকারিভাবে পেলাম এবং মানুষের ভালোবাসাও পেলাম, তখন আনন্দটা আরও গভীর হলো। আমি আসলে সবাইকে দেখাতে চাই, মাটির প্রতি, পরিবেশের প্রতি, দেশের প্রতি আমাদের দায়িত্বশীল হওয়া দরকার।
পরিবেশের প্রতি আপনার যে সচেতনতা, সেটি কীভাবে গড়ে উঠল?
শৈশব থেকেই আমার প্রকৃতির প্রতি টান ছিল। আবার বাবাও একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ছিলেন। বাবাই প্রথমে বাড়ির আঙিনা ও আশপাশে গাছ লাগাতেন। সেখান থেকেই আমার মধ্যে গাছের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। পরে যখন আমি নিজে গাছ লাগাতে শুরু করি, তখন বই বিলির ধারণাটাও মাথায় আসে। আবার আমি যেহেতু প্রায়ই বিভিন্ন গ্রামে যাই, ভেবেছিলাম যদি সেখানে মানুষকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করা যায়, তবে তা দেশের জন্য ফলপ্রসূ হবে। ভবিষ্যতে আমি চাই আকাশের নিচে, গাছের ছায়ায় মানুষের জন্য একটি বিশ্রামের জায়গা তৈরি করতে। যেহেতু কৃষিকাজের সময় আমি গাছতলায় বসে বিশ্রাম নেওয়ার আনন্দ পেয়েছি, তাই সেই আনন্দ আরও বেশি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই।
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আপনাকে কী কী কষ্ট ও বাধার মুখে পড়তে হয়েছে?
এ কাজে আমাকে নানা সামাজিক ও আর্থিক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল চারা কিনতে গেলে বা কর্মসূচি চালাতে গেলে ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হতো। অনেকেই আমাকে বিরক্ত করেছে, ছোট করেছে, সহযোগিতা করা হয়নি; এমনকি
চারা কিনতে গেলে সহজে সহায়তা বা ভালো দামে উৎসাহকারী কম পেয়েছি। তবু আমি হতাশ হইনি। পরে লোকেরা দেখল আমার কাজ সত্যিকারের ফল দিচ্ছে একপর্যায়ে আমাকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানও দেওয়া হলো। সেই স্বীকৃতি ও মানুষের ভালোবাসাই এখন আমার সবচেয়ে বড় সান্ত¡না।
আকাশতলার পাঠশালা নিয়ে আপনি কী ধরনের কাজ করেন?
প্রথমে যখন আমি গাছ আর বীজ নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় যেতাম, তখন সেখানকার মানুষদের পাশাপাশি বাচ্চাদের হাতে বই তুলে দিতাম। বেশির ভাগ বই আমি নিজেই কিনেছি নিজের টাকায়। তবে মহিত কামাল, ইমদাদুল হক মিলন, সেলিনা হোসেনসহ কয়েকজন লেখকও আমাকে কিছু বই দিয়েছেন। আমি কখনো অন্যের ভরসায় থাকিনি।
নিজের উদ্যোগেই এ কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছি। ছাগল-খাসি লালন পালন করে যে আয় হয়, সেখান থেকেই বই কিনে বাচ্চাদের হাতে তুলে দিই। এভাবেই আকাশতলার পাঠশালা চলছে বই পড়া আর প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বন্ধন গড়ে তোলার জন্য।
আপনার কাজগুলোয় পারিবারিক সহযোগিতা কতটা পেয়েছেন?
শুরুর দিকে কিছুটা মনোমালিন্য হলেও পরে পরিস্থিতি বদলে যায়। আমার আব্বু যখন বাইরে গেছেন, তখন অনেকেই তাকে বলেছেন তার ছেলে বই দিয়েছে পড়ার জন্য, গাছ দিয়েছে রোপণের জন্য। তারা প্রশংসা করেছেন, ভালো লাগার কথা জানিয়েছেন। এসব শুনে আব্বুর মনেও আনন্দ এসেছে। আসলে এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমার আব্বু–-আম্মু কখনো আমার কাজে বাধা দেননি। বরং নীরবে সহযোগিতা করেছেন। এটা আমার কাছে সত্যিই অনেক বড় প্রাপ্তি।
একজন স্বপ্নবাজ মানুষ হিসেবে নিজেকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেন?
আমি যে কাজ শুরু করেছি গাছ লাগানো, বই বিতরণ, পরিবেশ সচেতনতা তৈরি; এগুলোই আমার স্বপ্ন, আর আমি চাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ কাজ চালিয়ে যেতে। এটা আমার কাছে বড় এক চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিন সাইকেল নিয়ে গ্রামের পথে ঘুরি, মাটির কাছে থাকি, গাছ লাগাই, বই বিলি করি।
এটা আমার কাছে এক ধরনের পরীক্ষার মতো, আর আমি চাই এই পরীক্ষা সারা জীবন দিতে। আমার স্বপ্ন হচ্ছে কাজের ভেতর দিয়ে ভালো বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। আমি দেখি, পথেঘাটে অসংখ্য গাড়ি চলছে, যার অনেকটাই আসলে বিলাসিতা বা ফ্যাশন, জরুরি প্রয়োজনে নয়। অথচ এ গাড়িগুলো প্রচুর কার্বন ছাড়ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়ন বাড়িয়ে দিচ্ছে। শতকরা ৬০ ভাগের বেশি মানুষ গাড়ি ব্যবহার করছে, আর তার প্রভাব প্রকৃতির ওপর মারাত্মক।
আমি তাই সাইকেল চালিয়ে কাজ করি, মানুষকে বোঝাতে চাই গাড়ি না ব্যবহার করেও চলাফেরা করা যায়, দূষণ ছাড়াও জীবনকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। আমার স্বপ্ন এ বার্তাটাই ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে মানুষ প্রকৃতির প্রতি আরও দায়িত্বশীল হয়।