ঢাকা মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫

দুর্নীতিতে অভিযুক্ত পলাশ এখন দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সম্পাদক!

ঝালকাঠি প্রতিনিধি
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২৫, ০৯:৪০ পিএম
অভিযুক্ত এ.বি.এম আনিসুর রহমান পলাশ।

ঝালকাঠির উদ্বোধন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ.বি.এম. আনিসুর রহমান পলাশের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম, জাল সনদে নিয়োগ গ্রহণ ও তহবিল আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এত অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি সম্প্রতি জেলার দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির (দুপ্রক) সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন।

স্থানীয়রা বলছেন, যিনি নিজেই অনিয়ম ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, তার হাতে দুপ্রক বা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ায় জনমনে বিস্ময় ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

অভিযোগে জানা গেছে, ২০০১ সালে বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু আনিসুর রহমান ‘শিক্ষক কাম করণিক’ পদে চাকরির অভিজ্ঞতা দেখিয়ে আবেদন করেন এবং ওই সনদের ভিত্তিতে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন। অভিযোগকারীদের দাবি, ‘শিক্ষক কাম করণিক’ নামে কোনো পদ সরকারি জনবল কাঠামোয় নেই—তাই ওই অভিজ্ঞতা সনদটি জাল। তৎকালীন প্রার্থী মনজুরুল হক প্রথম স্থান অর্জন করেও অভিজ্ঞতা না থাকার অজুহাতে বাদ পড়েন। পরে এ নিয়ে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির বৈঠকেও আপত্তি তোলা হয়।

এরপর ২০১৮ সালে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে আনিসুর রহমান প্রধান শিক্ষক পদে যোগদানের পর বিদ্যালয়ের আর্থিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম তার একক নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। অভিযোগ রয়েছে, তিনি কমিটির অনুমোদন ছাড়াই বাজেট ব্যয় করেন, আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা রাখেননি এবং বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবও নিজ ক্ষমতায় পরিচালনা করেছেন। এতে দীর্ঘ সাত বছরে বিদ্যালয়ের নানা তহবিল ব্যবহারে অসংখ্য গড়মিলের অভিযোগ উঠেছে।

সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগ হলো টিফিন ফান্ডে অনিয়ম। এ বিষয়ে আদালতে একটি নালিশি অভিযোগ করা হয়। বিদ্যালয়ের ১১০০ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মাসে ৭৫ টাকা করে টিফিন ফি নেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে প্রতিদিন টিফিন দেওয়া হয় গড়ে ৫০০ জন শিক্ষার্থীকে, যার প্রতিদিনের খাবারের মূল্য সর্বোচ্চ ৫ টাকা। ফলে বছরে প্রায় ৮ থেকে ৯ লাখ টাকার টিফিন ফান্ড ব্যয়ের হিসাব পাওয়া গেলেও এর কোনো ভাউচার, রশিদ বা সরবরাহ রেজিস্টার নেই। একাধিক শিক্ষক ও অভিভাবক জানিয়েছেন, এসব টাকা বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে জমা না হয়ে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে সন্দেহ রয়েছে।

একজন অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, টিফিনের টাকা, ম্যাগাজিন ফান্ড, উন্নয়ন অনুদান—সবখানেই অনিয়ম। প্রধান শিক্ষক নিজের বাড়িতে প্রতিদিন টিফিন পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের সব কিছু নিজের মতো চালান। কেউ প্রশ্ন তুললে তাকে ভয়ভীতি দেখান।

এ ছাড়া পুরাতন বেঞ্চ, নির্মাণ সামগ্রী ও বই বিক্রি করে পাওয়া অর্থ বিদ্যালয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা না দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিক্রির কোনো রশিদ, অনুমোদনপত্র বা ব্যাংক স্টেটমেন্টে এসব জমার তথ্য মেলেনি। বিদ্যালয়ের তহবিল খরচে কোনো স্বচ্ছতা ছিল না বলেই অভিযোগকারীরা দাবি করছেন। এ ছাড়া তিনি বিদ্যালয়ের মাঠে অবৈধভাবে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের ঠিকাদার জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মনিরুল ইসলাম তালুকদারের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকার সুবিধা নিয়েছেন।

২০১৯ সালের অডিটেও উঠে আসে নতুন এক অধ্যায়। সেই সময়ের অডিট চলাকালে আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রায় আড়াই লাখ টাকা ‘ঘুষ’ দিয়ে অনিয়ম ঢেকে ফেলার অভিযোগ ওঠে। তবে অডিট রিপোর্টে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না থাকায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রিপোর্টটি ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন করা হয়েছিল কি না।

অভিযোগ শুধু আর্থিক নয়, প্রশাসনিকভাবেও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ রয়েছে। ম্যানেজিং কমিটির কয়েকজন সদস্য লিখিতভাবে জানিয়েছেন, প্রশ্ন তুললেই প্রধান শিক্ষক তাদের কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার বা ক্ষতিপূরণ দাবি করার হুমকি দেন। ফলে অনেকেই নিরুপায় হয়ে চুপ থাকেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তিনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দলীয় বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার একাধিক পোস্ট ও ছবি রয়েছে, যেখানে তিনি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সক্রিয় ছিলেন। তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মমতাময়ী মা এবং স্বপ্ন পূরনের সারথি দাবি করে কবিতা লিখে ফেইসবুকে পোস্ট করেন। 

তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকেই তার চরিত্রে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। তিনি হঠাৎ বিএনপি ও এর নেতাদের প্রশংসা শুরু করেন এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কবিতাও লিখেছেন। স্থানীয়রা বলছেন, রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি নিজের অবস্থান বারবার পরিবর্তন করছেন। নিজের ভিজিটিং কার্ডে তিনি নিজেকে শিক্ষাবিদ ও কবি লিখেছেন। সবসময় তিনি প্রভাবশালীদের তোষামোদে ব্যস্ত থাকেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, তিনি শিক্ষকতার বাইরে বহু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে সবসময় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকেন। বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের কথা চিন্তা না করে তিনি এসব সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই সময় ব্যয় করেন। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন—একজন প্রধান শিক্ষক এত সংগঠন পরিচালনার সময় কোথা থেকে পান?

এ ছাড়া, উদ্বোধন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্টল ভাড়ার অর্থ আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন, বিদ্যালয়ের আয়োজিত ইফতার মাহফিলের টাকা, দোকান ও স্টল থেকে নেওয়া ভাড়ার টাকা বিদ্যালয়ের হিসাব বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, বরং ব্যক্তিগতভাবে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

সবশেষে আরও বিস্ময়ের বিষয় হলো—এত অভিযোগ থাকা সত্বেও পলাশকে ২০২৫ সালে জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির (দুপ্রক) সম্পাদক পদে নিযুক্ত করা হয়। স্থানীয় নাগরিকদের দাবি, এটি জনস্বার্থবিরোধী এবং নৈতিকতার পরিপন্থী একটি সিদ্ধান্ত।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০১ সালে ভুয়া সনদে নিয়োগ, ২০১৮ সালে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান, ২০১৯ সালের অডিটে অনিয়ম, ২০১৮ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত টিফিন ও উন্নয়ন ফান্ডে দুর্নীতি, স্টল ভাড়া আত্মসাৎ এবং ২০২৫ সালে দুপ্রকের সম্পাদক পদ গ্রহণ—এই পুরো সময়জুড়ে একাধিক লিখিত অভিযোগ বিভিন্ন দপ্তরে দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক আনিসুর রহমান পলাশ বলেন, ‘আমি নিয়ম অনুযায়ী পদায়ন পেয়েছি। আমি কখনোই ক্লার্ক ছিলাম না। তা ছাড়া আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার সবকিছুই ভিত্তিহীন। প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দায়িত্ব পালন করতে গেলে রাজনৈতিক দলের সাথে যতটুকু সম্পর্ক রাখতে হয় আমি ততটুকুই রাখছি।’  

বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মামুনুর রশীদ রনি বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক পলাশ স্যার বিদ্যালয়ের সবকিছু নিজের মতো করে পরিচালনা করেন। টিফিন ফান্ডের টাকার হিসাব নিয়ে বহুবার প্রশ্ন তোলা হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যেত না। তার মতে, পলাশ স্যার শিক্ষার মানোন্নয়নের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থে বেশি ব্যস্ত থাকতেন। রনির ভাষায়, ‘এমন শিক্ষক জাতির জন্য কলঙ্ক, যিনি নিজের দায়িত্বের পরিবর্তে তোষামোদ ও স্বার্থসিদ্ধিতেই মনোযোগ দেন।’

সাবেক দাতা সদস্য আজাদ রহমান বলেন, তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে বিদ্যালয়ের আর্থিক লেনদেনে কোনো স্বচ্ছতা দেখেননি। টিফিন, উন্নয়ন কিংবা বই বিক্রির টাকা যথাস্থানে যেত না, অভিযোগ জানানো হলেও তার কোনো প্রতিকার মিলত না। এত অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার পরও তাকে দুপ্রকের সম্পাদক করা লজ্জার বিষয়।

ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সদস্য মশিউর রহমান নিলু জানান, প্রধান শিক্ষক পলাশ বিদ্যালয়ের অর্থ ও প্রশাসন পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। কমিটির সভায় একাধিকবার অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় তোলা হলেও পলাশ তা উপেক্ষা করতেন। তার মতে, এই অনিয়মগুলো নতুন নয়; বরং বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। নিলু আরও বলেন, এতসব অভিযোগের পরও তাকে পুরস্কৃত করা সত্যিই হতাশাজনক।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল জব্বার বলেন, আমি যোগদানের পর এ বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। তবে তার বিরুদ্ধে মৌখিকভাবে বেশ কিছু অভিযোগ শুনেছি। তদন্ত ছাড়া কিছুই বলা যাচ্ছে না। তার অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করা হলে এবং সত্য প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম বলেন, দুপ্রকের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে তিনি সদস্যছিলেন। গত আওয়ামী লীগের আমলে ২০২২ সালে আনিসুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হন। এবারও তাকে কমিশন থেকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। আমাদের কাছে তার বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। এ ছাড়া এ জাতীয় নিয়োগের আগে এনএসআই, ডিএসবি তদন্ত করে থাকে তারাও নেগেটিভ কিছু পায়নি।

দুর্নীতি দমন কমিশন পিরোজপুর জোনের উপপরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হবে।’

ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক আশরাফুর রহমান বলেন, ‘আমি যোগদানের পরে তার বিরুদ্ধে কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’